ই-পেপার রোববার ১৯ মে ২০২৪
রোববার ১৯ মে ২০২৪

তাপপ্রবাহ ও গ্রীষ্মের ছুটি
প্রকাশ: রবিবার, ৫ মে, ২০২৪, ১:৫২ এএম আপডেট: ০৫.০৫.২০২৪ ৭:৫৮ এএম  (ভিজিট : ৫৫১)
একসময় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সাপ্তাহিক ছুটি ছিল এক দিন। নতুন কারিকুলাম প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন বিষয়ে নানা বিশ্লেষণের পর নতুন কারিকুলামে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সাপ্তাহিক ছুটি দুদিন করা হয়। এতে অন্যান্য সরকারি চাকরির ক্ষেত্রে বিদ্যমান সাপ্তাহিক ছুটির সঙ্গে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সাপ্তাহিক ছুটির একটি সমতা প্রতিষ্ঠিত হয়। 

ইতিমধ্যেই শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা শনিবারের সাপ্তাহিক ছুটির সঙ্গে নিজেদের খাপ খাইয়ে নিয়েছেন। এই অভ্যস্ত বিষয়ে হঠাৎ পরিবর্তন ঘটলে তাতে সাধারণত কোনো সুফল আসে না। বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও মহামারির সময়ও জনস্বাস্থ্যের বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সাময়িক ছুটি ঘোষণা করা হয়। 

সাময়িক ছুটির ক্ষতি পুষিয়ে নেওয়ার দায়িত্ব প্রথমত শিক্ষকদের ওপর বর্তায়। শিক্ষকরা বেশি পড়িয়ে কিংবা অতিরিক্ত ক্লাস নিয়ে সে ক্ষতি পুষিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেন। শিক্ষার্থীরাও তখন একটু বেশি বেশি পড়ে সিলেবাস শেষ করে নেয়। কিন্তু ক্ষতি পুষিয়ে নেওয়ার জন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সাপ্তাহিক ছুটি বাতিল করার প্রয়োজন হয় না।

আগেও কখনো সাপ্তাহিক ছুটি বাতিল করা হয়নি। কারণ সাপ্তাহিক ছুটি শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের যাপিত জীবনের সঙ্গে অ্যাডজাস্ট হয়ে যাওয়া একটি বিষয়। চলমান তাপপ্রবাহে যখন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলা রাখাটাই অসহনীয় সেখানে শনিবারের সাপ্তাহিক ছুটি বাতিল করে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলা হয়েছে। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের এ সিদ্ধান্ত নিয়ে জনমনে সৃষ্টি হয়েছে মিশ্র প্রতিক্রিয়া।

শিক্ষামন্ত্রী অবশ্য বলেছেন, শনিবারের সাপ্তাহিক ছুটি বাতিলের বিষয়টি সাময়িক। কিন্তু প্রচণ্ড গরমে যে সময়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলা রাখাই দুষ্কর সে সময়ে সাপ্তাহিক ছুটি বাতিল করে কোনো সুফল লাভ করা যাবে কি? এ প্রশ্নও জেগেছে জনমনে। প্রকৃতপক্ষে শিক্ষাদান ও শিক্ষা গ্রহণ একটি মনস্তাত্ত্বিক প্রক্রিয়া। শিক্ষক ও শিক্ষার্থী যদি কোনো বিধি মানসিকভাবে গ্রহণ না করে তা হলে সে বিধি আরোপ করে শিক্ষাক্ষেত্রে কোনো সুফল লাভ করা সম্ভব নয়।

পবিত্র রমজান ও ঈদুল ফিতর ও পহেলা বৈশাখের ছুটির পর গত ২১ এপ্রিল স্কুল, কলেজ ও মাদরাসা খুলে দেওয়ার কথা থাকলেও দেশজুড়ে হিট অ্যালার্ট ও প্রচণ্ড তাপপ্রবাহের কারণে সে কথা ঠিক রাখা সম্ভব হয়নি। আবহাওয়া অধিদফতরের পরামর্শ আমলে নিয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে চলমান ছুটির সঙ্গে আরও এক সপ্তাহ ছুটি বৃদ্ধি করতে হয়েছিল। কারণ, শিক্ষার বিষয়টি যত গুরুত্বপূর্ণই হোক-জনস্বাস্থ্য ও জীবনের ঝুঁকিকে সব সময়ে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিতে হয়। এক সপ্তাহের বাড়তি ছুটি শেষ হওয়ার পরও গরমের তীব্রতা কমেনি। এদিকে শিক্ষা মন্ত্রণালয় আর ছুটি বৃদ্ধি করতে চাচ্ছে না। তীব্র তাপপ্রবাহ ও হিট অ্যালার্টের মধ্যেই গত ২৮ এপ্রিল স্কুল-কলেজ-মাদরাসা খুলে দেওয়া হয়েছে। 

এতে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা ক্লাসে ফিরলেও প্রচণ্ড গরমে বিভিন্ন স্থানে অনেক শিক্ষক ও শিক্ষার্থী অসুস্থ হয়ে পড়ে। গরমে অসুস্থ হয়ে শিক্ষকসহ বেশ কয়েকজনের মৃত্যুর সংবাদও গণমাধ্যমে প্রকাশ হয়। পরিস্থিতি আমলে নিয়ে দেশের যেসব জেলায় তাপমাত্রা ৪০ বা ৪০ ডিগ্রি অতিক্রম করবে সেসব জেলায় ছুটি বহাল রাখার সিদ্ধান্ত নেয় শিক্ষা মন্ত্রণালয়। এদিকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছুটি নিয়ে নানা মুনির নানা মত প্রকাশের মধ্য দিয়ে বিষয়টি এখন দেশের প্রধান সংবাদ হয়ে উঠেছে। 

শিক্ষা মন্ত্রণালয় আবহাওয়া অধিদফতরের বিবৃতি ও আদালতের নির্দেশনা কতটা আমলে নিচ্ছে বা নিচ্ছে না-সেটিও এখন অভিজ্ঞ মহলে ব্যাপকভাবে আলোচনা হচ্ছে। এরই মধ্যে এক সপ্তাহের বাড়তি ছুটির ক্ষতি পুষিয়ে নেওয়ার জন্য শিক্ষা মন্ত্রণালয় শনিবারের সাপ্তাহিক ছুটি বাতিল করেছে। বিষয়টি একেবারে অপ্রত্যাশিতও নয়। পবিত্র রমজানে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছুটির বিষয়টি আদালত পর্যন্ত গড়ালে শিক্ষামন্ত্রী তার এক বক্তৃতায় শনিবারের সাপ্তাহিক ছুটি বাতিল করার ইঙ্গিত দিয়েছিলেন। তবে সেটি যে এই তীব্র তাপপ্রবাহের মধ্যেই করে ফেলবেন-এটি ভাবা যায়নি। এক সপ্তাহের ক্ষতি পূরণের জন্য পরপর পাঁচ শনিবার খোলা রাখার ঘোষণা হতে পারত। শিক্ষামন্ত্রী মহোদয়ের ‘সাময়িক সময়ের জন্য’ কথাটি অস্পষ্ট বিধায় অনেকেই মনে করছেন শনিবারের সাপ্তাহিক ছুটি বাতিল হয়ে গেল।

যে তাপপ্রবাহের কারণে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলা রাখার যৌক্তিকতা নিয়ে বিভিন্ন মহলে প্রশ্ন উঠছে সে তাপপ্রবাহ চলমান থাকতেই সাপ্তাহিক ছুটি বাতিল করে ক্ষতিপূরণের চেষ্টা মনস্তাত্ত্বিক দৃষ্টিকোণ থেকে খুব একটা ফলপ্রসূ মনে করা যায় না। একসময় এ ধরনের গরম পড়লে ক্লাস কার্যক্রম একেবারে বন্ধ না করে স্কুলের ক্লাস কার্যক্রমের সময়টা শিফট করে দেওয়া হতো। ভোরে স্কুল শুরু হয়ে আবহাওয়া প্রচণ্ডভাবে উত্তপ্ত হওয়ার আগেই ক্লাস কার্যক্রম শেষ হতো। প্রয়োজনে কিছু নন-মূল বিষয়ের ক্লাস কমিয়ে দেওয়া হতো। এতে ক্লাস কার্যক্রম একেবারে বন্ধ হতো না। প্রচণ্ড গরমের দিনে এ ধরনের সকালের স্কুলের অভিজ্ঞতা প্রায় সবারই আছে। এখন কেন এ ধরনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় না-আমার সীমিত জ্ঞানে বিষয়টি বুঝে আসছে না।

এদিকে গরমে স্কুল খোলা নিয়ে অভিভাবকদের মধ্যে ভিন্ন মতের শেষ নেই। কেউ খোলা রাখার পক্ষে। কেউ বন্ধ রাখার পক্ষে। অনেকেই বলছেন, স্কুল খোলা থাকলেও বাচ্চাকে স্কুলে পাঠাবেন না। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রকাশিত এ ধরনের মতামতকে কর্তৃপক্ষ সাধারণত আমলে নেন না। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রকাশিত মতামত নিয়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান চালানো যাবে না বলে শিক্ষামন্ত্রীর বক্তব্যও গণমাধ্যমে প্রকাশ হয়েছে। তবে জনমতকে একেবারে উড়িয়ে দেওয়া কোনো গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া নয়। যে সংকটকে কেন্দ্র করে শনিবারের সাপ্তাহিক ছুটি বাতিল করা হলো সেটি কোনো স্থায়ী সংকট নয়। যেকোনো দিন বৃষ্টি হলেই এবং মাঝেমধ্যে বৃষ্টি হতে থাকলে এ সংকট কেটে যাবে। তাই বিষয়টি নিয়ে বেশি দিন ভাবতে হবে না। সেই বিবেচনায় আজ স্কুল খুলছে। তবে এ সময়ের মধ্যে হিটস্ট্রোকে যাদের মৃত্যু হয়েছে গরম যত দ্রুতই কমে যাক-তারা আর ফিরে আসবে না।

প্রচণ্ড গরমের মধ্যে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ বা খোলা রাখার বিষয়ে একেক সময় একেক সিদ্ধান্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সংশ্লিষ্টদের জন্যও এক ধরনের সমস্যা সৃষ্টি করছে। যতদূর জানা গেছে এ গরমে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলা রেখেও কোনো লাভ হচ্ছে না। একদিকে অনেক শিক্ষার্থীর ক্লাসে অনুপস্থিতি, অন্যদিকে উপস্থিত শিক্ষার্থীদের অমনোযোগিতা শিক্ষা কার্যক্রমকে ব্যাহত করছে। নতুন কারিকুলাম অনুযায়ী প্রবর্তিত শনিবারের সাপ্তাহিক ছুটি বাতিল করার উপযুক্ত সময় এটি নয় বলেও অনেকে মনে করছেন। ক্লাস কার্যক্রমই যেখানে ফলপ্রসূ হচ্ছে না সেখানে শনিবার খোলা রেখে ক্ষতি পোষানো কীভাবে সম্ভব? আসলে যেটি করা যথাযথ সেটি হলো ক্লাসের সময় পরিবর্তন করা। দেশের বেশিরভাগ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এক শিফটে চলে। এক শিফটে চলা এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ক্লাস কার্যক্রম সহজেই ভোর ৬টা থেকে শুরু করে সকাল ১০-১১টার মধ্যে শেষ করা যেতে পারে। দুই শিফটের স্কুলে এক দিন পরপর দুই শিফটের ক্লাসই সকালে করা যেতে পারে। তীব্র তাপপ্রবাহে এ সাময়িক ব্যবস্থা সবার জন্যই সহনীয় হবে। সাপ্তাহিক ছুটি বাতিল করার প্রয়োজন হবে না। 

বাংলাদেশ ঋতুবৈচিত্র্যের দেশ। শীত-গ্রীষ্মের বিষয়টি বিবেচনায় রেখে স্থানীয়ভাবেই স্কুল আওয়ার পরিবর্তন করা যায়। প্রচণ্ড গরমে সকালে এবং প্রচণ্ড শীতে দুয়েক ঘণ্টা পিছিয়ে ক্লাস কার্যক্রম চালানোর সিদ্ধান্ত স্কুল কর্তৃপক্ষই নিতে পারে। বাংলাদেশে এখনও অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মাঠে হাট বসে। সেখানে স্থানীয় প্রশাসনের সঙ্গে কথা বলে ‘হাফ-স্কুল’ চালানোর সিদ্ধান্ত প্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষই নিয়ে থাকে। সে কারণে একেক দিন একেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে হাফ-স্কুল চলতে দেখা যায়। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সবকিছু সব সময়ে কেন্দ্র থেকে নিয়ন্ত্রণ করা যায় না। স্থানীয় আর্থ-সামাজিক ও ভৌগোলিক বিষয় কেন্দ্র নয়; স্থানীয় কর্তৃপক্ষই ভালো বুঝতে পারে। কিন্তু বর্তমানে আমাদের দেশে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর ব্যাপারে কেন্দ্রীয়ভাবে সিদ্ধান্ত দেওয়ার একটি সংস্কৃতি চালু হয়েছে। এতে কিছু কিছু ক্ষেত্রে সুবিধা হলেও অনেক ক্ষেত্রে অসুবিধাও দেখা দেয়। শিক্ষার্থীরা যেহেতু স্কুলের তত্ত্বাবধানে থাকে। তাই সমস্যাগুলো সমাধানের এখতিয়ার স্কুল কর্তৃপক্ষের হাতে থাকাই সুবিধাজনক। প্রয়োজনবোধে শিক্ষার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট অধিদফতরগুলো এ ব্যাপারে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে পরামর্শ দিতে পারে।

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বার্ষিক ছুটির একটি তালিকা আছে। সেখানে গ্রীষ্মের ছুটিও অন্তর্ভুক্ত। প্রতি বছরই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এ গ্রীষ্মের ছুটি দেওয়া হয়। সরকার অনুমোদিত এ ছুটির তারিখ নির্ধারিত থাকলেও চলমান তাপপ্রবাহের কারণে ছুটিটি এখন এ সময়ে নিয়ে আসা যায়। এখন যেহেতু গরমের তীব্রতা অনেক বেশি এবং অনেক শিক্ষার্থী ক্লাসে উপস্থিত হচ্ছে না তাই গ্রীষ্মের ছুটি নির্দিষ্ট সময়ের বদলে চলমান তাপপ্রবাহের সময়ে বহাল করলে বার্ষিক ছুটির কোনো হ্রাস-বৃদ্ধি ঘটবে না। জনস্বাস্থ্যের কথা বিবেচনা করে শিক্ষা মন্ত্রণালয় এ ধরনের সিদ্ধান্ত নিতেই পারে। দেশের অনেক জায়গাতে বৃষ্টি হওয়াতে তাপ প্রবাহ কিছুটা কমে এসেছে। তাই আজ থেকে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো খুলে দেওয়া হয়েছে।

গবেষক
ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশ স্টাডিজ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়

সময়ের আলো/আরএস/ 




https://www.shomoyeralo.com/ad/1698385080Google-News-Update.jpg

সর্বশেষ সংবাদ

সর্বাধিক পঠিত


ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: কমলেশ রায়, আমিন মোহাম্মদ মিডিয়া কমিউনিকেশন লিমিটেড এর পক্ষে প্রকাশক গাজী আহমেদ উল্লাহ
নাসির ট্রেড সেন্টার, ৮৯, বীর উত্তম সি আর দত্ত সড়ক (সোনারগাঁও রোড), বাংলামোটর, ঢাকা।

ফোন : +৮৮-০২-৯৬৩২৩৬৮-৭৪, ফ্যাক্স : +৮৮-০২-৯৬৩২৩৭৫ | ই-মেইল : shomoyeralo@gmail.com
close