ই-পেপার মঙ্গলবার ২২ অক্টোবর ২০২৪
মঙ্গলবার ২২ অক্টোবর ২০২৪

মাঝি
প্রকাশ: শনিবার, ২৪ সেপ্টেম্বর, ২০২২, ৩:২৮ পিএম  (ভিজিট : ১৩৩৬)
বাবাকে প্রায়ই আমি একটা কবিতা আবৃত্তি করে শোনাতাম। রবিঠাকুরের কবিতা-‘মা, যদি হও রাজি,/বড় হয়ে আমি হব খেয়াঘাটের মাঝি।’ শুনে বাবা-মা দুজনই হাসতেন। বাবা বলতেন, ‘মাঝি হইবা কেন তুমি বাজান। বড় হইয়া তুমি জাহাজ চালাইবা। না, প্লেন চালাইবা তুমি। নীল আকাশে ভোঁ ভোঁ কইরা উইড়া বেড়াইবা। আমি চাইয়া দেখুম।’

আমাদের গ্রামের পূর্ব দিকের প্রান্তে ছোট এক নদী। ওই পারে আরেকটা গ্রাম। নৌকা দিয়ে এপার-ওপার হয় লোকজন। ডানদিক দিয়ে নদীটা মিশেছে বিশাল মেঘনার সঙ্গে। সেখানে যেতে হলে ট্রলার লাগে অবশ্য। আমার বাবা নৌকাটা দিয়ে এপার থেকে ওপার নিয়ে যান যাত্রীদের। আমাকেই নিয়ে গেছেন কতবার। ট্রলারে চড়ে বড় নদীতে, নদী পার হয়ে জেলা শহর, সেখানে অবশ্য যাওয়া যায় না বাবা ছোট এই নৌকা দিয়ে। কিংবা যাওয়া যায়, আমি জানি না।

আমাদের বিদ্যালয়ে বাংলার নতুন এক আপা এসেছেন। ফাতিমা আপা। আমাদের বাড়ি কোন গ্রামে, বাবা কী করেন জিগ্যেস করেছিলেন কাল। ব্যবসায়ী, কৃষক, ঠিকাদার, গাড়িচালকদের ভিড়ে একমাত্র আমার বাবা মাঝি। শুনে হেসে ফেলেছিল রবিন। ওর বাবার তিনটা ট্রাক। আপা সবাইকে বলেছিলেন, ‘মানুষ সবাই সমান। সৎ যেকোনো পেশাকে আমরা সম্মান করব। হালাল এক টাকা উপার্জনও, দুর্নীতি করে এক কোটি টাকা কামানোর চেয়ে উত্তম। আমরা কাউকে ছোট করে কথা বলব না।’ ক্লাস শেষে রবিন চুপিচুপি আমাকে বলেছিল, ‘স্যরি, দোস্ত। ভুল হয়ে গেছে।’ আশ্বিন মাস। এক দুদিন পরপর বৃষ্টি হচ্ছে। বাবা আসতে আসতে বাজে রাত দশটা। মা রান্না করেছেন খুদের চালের ভাত, আলুর ভর্তা, কাঁঠাল বিচির ভর্তা আর ডিম ভাজা। আমরা বসে আছি। বাবা আসলে একসঙ্গে খাব। বৃষ্টি যেন আজ থামছেই না। হঠাৎ চারদিক শোঁ শোঁ করে ঝড় উঠল।

ভাদ্র মাসে কালবৈশাখী এলো নাকি? বজ্রপাতের শব্দ শুনে আমি লুকাই মায়ের আঁচলে। ‘বাবা আসে না কেন, মা?’ বলে কান্না জুড়ে দিই আমি। ‘আল্লাহ ভরসা’ বলে মা অভয় দেন। আরও ঘণ্টা দুই চলে যান। মা এখন নিজেই ভয় পেয়ে গেছেন। বাবা ফেরেনি এখনও। পাশের বাসার জ্যাঠাদের কাছে খবর চলে গেছে। জ্যাঠারা লোক নিয়ে গেছেন বাবাকে খুঁজতে। কান্নার রোল ওঠে আমাদের বাড়িতে।

রাত শেষ হয়ে যাচ্ছে। বৃষ্টি থেমে গেছে মাঝরাতেই। দূরে ভেসে আসে ফজরের আজানের ধ্বনি। আমরা জড় হয়ে বসে আছি। ঘুম ছিল না সারা রাতে। সবার চোখ লাল আর ফোলা। বাবা আর ফিরবে না তাহলে? আমার বাবা? হঠাৎ জ্যাঠার গলার শব্দ। ‘আতিকের মা কই গেলা। আতিকের বাপরে লইয়া আইছি।’ ছুটে যাই আমরা। দুই-তিনজন মিলে বাবাকে কোলে করে নিয়ে আসছেন। বাবা তাকাচ্ছেন না, কিছু বলছেন না।

বাবা ফিরে এসেছেন তাতেই আমরা খুশি। লেপ দিয়ে ঢেকে, পায়ে গরম তেল মেখে, এক গ্লাস গরম দুধ খাইয়ে দেওয়ার পর যেন বাবার হুঁশ ফিরল। খুব কষ্টে কী যেন বলছেন আমার বাবা।
‘নয়টার পর নৌকা ঘাটে বাইন্ধা রাখি। মজনুর দোকানে বইসা চা খাইতে বসছি এমন সময় নামল ঝড়। ভাবলাম, একটু পরে যাই। আরও কিছুক্ষণ পর। হঠাৎ দেখি রবিউল ভাই। কোলে পোলা, রবিন। পেটে নাকি বেদম ব্যথা। জ্বর, ব্যথা আর বমিতে অবস্থা খারাপ। জেলা হাসপাতালে নিতে হবে। এদিকে ট্রলার নেই। মনে হয় শহর থেইকা ঝড়ের জন্য ফিরতে পারে নেই। রবিন আমার সামনেই আবার বমি কইরা চোখ উল্টাইয়া দিল। রবিউল ভাই হাত ধইরা কইল, আমার পোলারে বাঁচাও ভাই। আর কোনো নৌকাও নেই। আল্লাহর নাম নিয়ে নৌকা নামাইলাম মেঘনার দিকে। বৃষ্টিটাও কমে আসল। বাতাস ছিল, আমাদের যাওয়ার দিকেই জোর। চালাইতে সুবিধাই হইল। কোনো মতে গেলাম শহরে। এবার ফিরতে হয়। বাতাস এখন উল্টা দিকে। মাঝনদীতে আসতেই সে কী ঝড়। দূরে দেখলাম বড় একটা জাহাজের আলো। কাছাকাছি আসতেই নৌকা আমার ডুইবা গেল। আমি সাঁতরাই, কিন্তু জানে কুলায় না। হাত-পা অবশ হইয়া আসে। যখন সব শক্তি শেষ, তখনই জাহাজটা রশি দিয়ে আমারে টাইনা তুইলা আবার শহরের ঘাটে দিয়া যায়।’

মন্ত্রমুগ্ধ, বিস্মিত আর আতংকিত আমরা শুনে যাই এই গল্প। আমার মাঝি বাবা একটা জীবন বাঁচাতে কী বিশাল ঝুঁকি নিয়েছিলেন! আমি কান্না থামাতে পারি না। বাবা কাছে টেনে নেন আমাকে। চুমু দেন গালে, কপালে। ‘বাজান, কও দেখি সেই কবিতাটা। মা, যদি হও রাজি।’ খেয়াঘাটের মাঝি হওয়ার মতো বিশাল দায়িত্ব আর সাহস আমি নিতে পারব? আমার বাবার মতো?




সর্বশেষ সংবাদ

সর্বাধিক পঠিত


ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক : সৈয়দ শাহনেওয়াজ করিম, আমিন মোহাম্মদ মিডিয়া কমিউনিকেশন লিমিটেড এর পক্ষে প্রকাশক গাজী আহমেদ উল্লাহ। নাসির ট্রেড সেন্টার, ৮৯, বীর উত্তম সি আর দত্ত সড়ক (সোনারগাঁও রোড), বাংলামোটর, ঢাকা।
ফোন : +৮৮-০২-৯৬৩২৩৬৮-৭৪, ফ্যাক্স : +৮৮-০২-৯৬৩২৩৭৫ | ই-মেইল : shomoyeralo@gmail.com
close