ই-পেপার বুধবার ১ মে ২০২৪
বুধবার ১ মে ২০২৪

সম্মেলনে অর্থনীতিবিদরা
তদন্ত কার্যকর না হলে দুর্নীতির রাস্তা প্রশস্ত হয়
প্রকাশ: বুধবার, ২৯ ডিসেম্বর, ২০২১, ৮:০৮ পিএম  (ভিজিট : ৩৮৬)
ব্যাংক খাতের বিভিন্ন অনিয়মের তদন্ত প্রতিবেদন ড্রয়ারে গেলে দুর্নীতির প্রবাহ শুরু হয় এবং এতে করে দুর্নীতির রাস্তা প্রশস্ত হয়। ব্যাংক খাতে ঋণ খেলাপি বাড়ছে যা অর্থনীতির জন্য ভালো নয়। খেলাপির কারণে ব্যাংকগুলো ঋণ দিতে পারছে না। এর ফলে ব্যাংকগুলোর সক্ষমতা কমছে বলেও মন্তব্য করেন অর্থনীতিবিদরা। 

বুধবার রাজধানীর একটি পাঁচ তারকা হোটেলে বণিক বার্তা আয়োজিত দ্বিতীয় বাংলাদেশ অর্থনৈতিক সম্মেলনে এসব কথা বলেন বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ও বর্তমান গভর্নরবৃন্দ।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাবেক গভর্নর মোহাম্মাদ ফরাস উদ্দিন তার বক্তৃতায় বলেন, ‘ব্যাংক বা আর্থিক খাতের কোন দুর্নীতির তদন্ত প্রতিবেদন যদি ড্রয়ারে চলে যায় তবে দুর্নীতির প্রবাহ শুরু হয়। অবাধ দুর্নীতির রাস্তা প্রশস্ত হয়। এছাড়া, কোভিডকালে যে প্রণোদনা দেওয়া হয়েছে এর ৮০ শতাংশই পেয়েছে বড় উদ্যোক্তারা। ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা সেভাবে প্রণোদনার অর্থ পাননি। অথচ প্রণোদনার অর্থ বেশি পাওয়া উচিৎ ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা ও ব্যবসায়ীদের। তাদেও কাছে কীভাবে প্রণোদনা পৌঁছানো যায় সে বিষয়ে  আরও ভাবার আহ্বান জানান। মানি লন্ডারিং ঠেকাতে বাংলাদেশ ব্যাংককে গুরুত্বপূর্ণ ও কঠোর ভূমিকা পালনের ওপর জোর দেন সাবেক এই গভর্নর।

ফরাস উদ্দিন আরও বলেন, আমাদের দেশে খেলাপি বাড়ছে। ২০০০-‘০১ সালের দিকে খেলাপিকে সামাজিক ব্যাধি হিসেবে বোঝাতে চেয়েছি। তবুও খেলাপি কমানো যাচ্ছে না। এখন ঋণ খেলাপির পক্ষে যেন কোনো আইনজীবী না দাঁড়ায় এ নিয়ে নিরুৎসাহিত করতে হবে। সামাজিকভাবে ঋণ খেলাপিকে প্রতিরোধ করতে আহ্বান জানান তিনি।

রেমিট্যান্স সম্পর্কে তিনি বলেন, সম্প্রতি আমাদের রেমিট্যান্স কমছে, এটা ভালো মনে হচ্ছে না। আবার আমাদের রপ্তানিও কমছে। বিপরীতে ব্যাপক হারে বাড়ছে আমদানি। কেন এমন হচ্ছে, সেদিকেও নজর দিতে হবে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংক প্রসঙ্গে সাবেক এ গভর্নর বলেন, ‘কেন্দ্রীয় ব্যাংক প্রতিষ্ঠার শুরুতে বহির্বাণিজ্য কঠিন ছিল। নানা চ্যালেঞ্জ নিয়ে তা করে আমাদের সেন্ট্রাল ব্যাংক। এখন ডেভেলপমেন্টের ভূমিকা রাখছে সেন্ট্রাল ব্যাংক।’

প্রবাসী আয়ে ভাটা পড়েছে গেল কয়েক মাস ধরে। এর থেকে উত্তরণে প্রবাসী আয় বা রেমিট্যান্সে দেয়া প্রণোদনা আরও এক শতাংশ বাড়ানোর প্রস্তাব করেন সাবেক গভর্নর ড. আতিউর রহমান। তিনি বলেন, বর্তমানে প্রণোদনা দুই শতাংশ থেকে বাড়িয়ে তিন শতাংশ নগদ প্রণোদনা দেয়ার আহ্বান জানান তিনি।

তিনি আরও বলেন, অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারে দেশের কৃষি খাত ছিল রক্ষাকবচ। এর পরেই ভূমিকা রেখেছে প্রবাসী আয় ও রফতানি খাত। এছাড়া টেকসই অর্থনীতি বাস্তবায়নে আটটি সুপারিশ করেন তিনি।

দেশের অর্থনীতিতে বৈষম্য থাকার পরও অর্থনৈতিক সেবা পৌঁছে দেওয়া সম্ভব হয়েছে বলে মন্তব্য করেন আতিউর রহমান। তিনি বলেন, করোনাকালে সারা পৃথিবীর অর্থনীতি যখন ধ্বসে গেছে, বাংলাদেশের অর্থনীতি তখনও দাঁড়িয়েছিল। এটা সম্ভব হয়েছে প্রধানমন্ত্রীর দূরদর্শী নেতৃত্বের ফলে। করোনার কারণে আমাদের আমদানি বেড়েছে ৫৪ শতাংশ। আশার কথা হলো, এর বেশিরভাগই কাঁচামাল। ফলে এটা শিল্পের জন্য সম্ভাবনা সবচেয়ে বেশি বলে জানান সাবেক এ গভর্নর।

বর্তমান বাংলাদেশ ব্যাংক গভর্নর ফজলে কবির অনুষ্ঠানে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন। তার বক্তব্যে তিনি বলেন, ‘২০৩৫ সালের মধ্যে বাংলাদেশ বিশ্বের সেরা ২৫ অর্থনীতির দেশে পরিণত হবে। সামনের দিনে দেশের অর্থনীতিতে বেশ কয়েকটি চ্যালেঞ্জ রয়েছে। এর মধ্যে কোভিডের ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে নেতৃত্বের ভূমিকা পালন করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। কোভিড পরিস্থিতিতে বিশ্ব অর্থনীতি বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। নতুন করে দারিদ্রসীমায় প্রবেশের সংখ্যা বেড়েছে আশঙ্কাজনক হারে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের তুলনায় বাংলাদেশের অর্থনীতি তেমন একটা বিপর্যস্ত হয়নি।’ 

দেশের অর্থনীতির মেরুদণ্ড সোজা রাখতে এবং কোভিডের ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে বাংলাদেশ ব্যাংক নেতৃত্ব দিয়েছে বলে মন্তব্য করেন কেন্দ্রীয় ব্যাংক গভর্নর।

আরেক সাবেক গভর্নর সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, করোনার ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে সরকার ঘোষিত প্রণোদনা প্যাকেজ বাস্তবায়ন করেছে ব্যাংক খাত। এ জন্য অর্থনীতি এখনও টিকে আছে। মোবাইল সেবাদাতা প্রতিষ্ঠানও বড় ভূমিকা রেখেছে। করোনার মধ্যে এ সেবার মাধ্যমে মানুষ ঘরে বসে সব কাজ করতে পেরেছে।

ঋণ নিয়ে কেউ ফেরত দিবেন না এ চিন্তুা নিয়ে কেউ ব্যবসা করেন না বলে মন্তব্য করেছেন প্রধানমন্ত্রীর অর্থনৈতিক উপদেষ্টা মসিউর রহমান। তিনি বলেন, ‘ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ লাগাম ছেড়ে গেছে। ফলে ব্যাংক টাকা ফেরত পাচ্ছে না, ঋণ দেয়ার ক্ষমতা কমে যাচ্ছে। বড় বড় উদ্যোক্তা ঋণ নিয়ে ফেরত দেন না। তবে কেউ ঋণ নিয়ে ফেরত দেবেন না এ উদ্দেশ্যে ব্যবসা করেন না। সমস্যার কারণে হয়তো তারা দিতে পারেন না। ঋণ দেয়ার ক্ষেত্রে ব্যাংকগুলোকে আরও বিবচেনা করতে হবে।’

অর্থ বিভাগের সিনিয়র সচিব আব্দুর রউফ তালুকদার তার বক্তব্যে বলেন, করোনাকালীন সময়ে পৃথিবীর ৪১টি শীর্ষ দেশ যাদের জিডিপির প্রবৃদ্ধি হয়েছে এদের মধ্যে বাংলাদেশ শীর্ষে। এর কারণ হিসেবে অর্থ মন্ত্রণালয় ও বাংলাদেশ ব্যাংকের মধ্যকার যোগসূত্রকে উল্লেখ করেন তিনি।

রউফ তালুকদার আরও বলেন, ‘অর্থনৈতিক এই প্রবৃদ্ধিকে আরও গতিশীল রাখতে হলে বাংলাদেশ ব্যাংক ও অর্থ মন্ত্রণালয়ের মধ্যে সমন্বয়ের প্রয়োজন আছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রধান কাজ হলো ফাইন্যান্স ও মূল্যস্ফীতি স্থিতিশীল রাখা। কিন্তু সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংক দেশের উন্নয়নে ভূমিকা রাখছে। স্বাধীনতার ৫০ বছরে দেশের অর্থনীতি অনেক দূর এগিয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রধান কাজ ফাইনান্স ও মূল্যস্ফীতি স্থিতিশীল রাখা। তবে এর পাশাপাশি বাংলাদেশ ব্যাংক দেশের উন্নয়নেও ভূমিকা রাখছে। স্বাধীনতার ৫০ বছরে অর্থনীতি এগিয়েছে, সহজ হয়েছে, খরচ কমেছে। গত ১০ বছরে বাংলাদেশ ব্যাংকের অবদান হলো অটোমেশন বা স্বয়ংক্রিয়তা। একসময় সরকারিভাবে ১০০ টাকা বিতরণ করতে গেলে ২৫ টাকা খরচ করতে হতো, এখন তা হচ্ছে না। সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন অ্যাকাউন্টে চলে যাচ্ছে।’

তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ও বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ বলেন, বাংলাদেশের অনেক প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বলতা আছে। অনেক প্রতিষ্ঠানে দক্ষ ব্যবস্থাপনার অভাব রয়েছে। তবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিটি গভর্নর উপযুক্ত। ব্যাংকিং ব্যবস্থা হলো অর্থনীতির মস্তিষ্ক, হৃৎপিণ্ডও বলা যায়। দেশে এত উন্নয়নের পেছনে বড় ভূমিকা রাখছে ব্যাংক খাত। দেশের আর্থিক খাতে অনেক সংস্কার হয়েছে।

তবে আর্থিক খাতে এখনও অনেক চ্যালেঞ্জ রয়ে গেছে বলে জানান ওয়াহিদউদ্দিন। তিনি বলেন, মুক্ত অর্থনীতিতে যে কেউ শেয়ার কিনে ব্যাংকের মালিক হতে পারছে। একই পরিবারের কাছে যে কোনো ব্যাংকের ক্ষমতা চলে যাচ্ছে। এটার সংশোধন দরকার। সেটা এখনও হয়নি। 

আয়োজিত অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য রাখেন সিটি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মাশরুর আরেফিন।

এফএইচ




সর্বশেষ সংবাদ

সর্বাধিক পঠিত


ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: কমলেশ রায়, আমিন মোহাম্মদ মিডিয়া কমিউনিকেশন লিমিটেড এর পক্ষে প্রকাশক গাজী আহমেদ উল্লাহ
নাসির ট্রেড সেন্টার, ৮৯, বীর উত্তম সি আর দত্ত সড়ক (সোনারগাঁও রোড), বাংলামোটর, ঢাকা।

ফোন : +৮৮-০২-৯৬৩২৩৬৮-৭৪, ফ্যাক্স : +৮৮-০২-৯৬৩২৩৭৫ | ই-মেইল : shomoyeralo@gmail.com
close