আমেরিকার টুইন টাওয়ার হামলার ২০ বছর পূর্তি হচ্ছে আগামীকাল শনিবার। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সন্ত্রাসী ওই হামলার ঘটনা গত ২০ বছরে বিশ্ব রাজনীতি এবং নিরাপত্তায় প্রভাব ফেলেছে। এই সময়ে সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধের নামে যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বের একাধিক দেশে আক্রমণ করেছে কিন্তু টুইন টাওয়ার হামলার সঙ্গে জড়িত দেশটির বিরুদ্ধে কোনো অ্যাকশন নেয়নি। বিশেষজ্ঞরা আরও বলছেন, সন্ত্রাসী ওই হামলার প্রভাবে বাংলাদেশের নিরাপত্তার ওপরও হুমকি এসেছিল, যা এখনও বজায় আছে।
সৌদি আরবের বিরুদ্ধে কোনো অ্যাকশন নেওয়া হয়নি
সাবেক পররাষ্ট্র সচিব তৌহিদ হোসেন এই প্রতিবেদককে বলেন, ‘নাইন ইলেভেনের পর সো কলড ওয়ার এগেইনস্ট টেরর (সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ) তত্ত্ব ব্যবহার করে আমেরিকানরা আফগানিস্তান এবং একই ধারাবাহিকতায় ইরাক আক্রমণ করে, যা সম্পূর্ণ বেআইনি। গত ২০ বছরে আফগানিস্তান আক্রমণে বহু মানুষ মারা গেছে, দুই-তিন ট্রিলিয়ন ডলার খরচ হয়েছে, ফল হচ্ছে ২০ বছর আগে আফগানিস্তান থেকে যে তালেবানকে সরিয়েছিল আর ২০ বছর পর তারা সেই তালেবানের হাতেই আফগানিস্তান দিয়ে গেল। আলটিমেটলি আমেরিকানরা সো কলড ওয়ার এগেইনস্ট টেররের নামে বিশ্বে প্রচুর ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়েছে।’
সাবেক এই সচিব বলেন, ‘নাইন ইলেভেনের লিগেসি হচ্ছে, আমি যদি মনে করি তুমি আমার ক্ষতি করোনি কিন্তু আমি যদি মনে করি যে তুমি আমার ক্ষতি করার পরিকল্পনা করছ তা হলে আগেই তোমাকে আমি ধ্বংস করে দেব- এই তত্ত্বটা খুব বিপজ্জনক দুর্বল দেশগুলোর জন্য। খুব জটিল পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের মতো দেশগুলোর জন্যও এই তত্ত্ব বিপজ্জনক। এখন পর্যন্ত কেউই নিশ্চিত না যে কে এই হামলার মাস্টারমাইন্ড। আল-কায়েদা বা যারা এই ঘটনার কৃতিত্ব নেওয়ার চেষ্টা করছে, তারা যে এই কাজ করেছে তা প্রমাণিত না। যে দেশের লোকরা এই কাজ ঘটিয়েছে, যা প্রমাণিত, তাদের বিরুদ্ধে কোনো অ্যাকশনই নেওয়া হয়নি। সেই লোকগুলো ছিল সৌদি আরবের।’
অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল এবং বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব পিস অ্যান্ড সিকিউরিটি স্টাডিজের (বিআইপিএসএস) সভাপতি আ ন ম মুনিরুজ্জামান এই প্রতিবেদককে বলেন, ‘টুইন টাওয়া হামলার প্রভাব এখনও রয়ে গেছে। ওই ঘটনা বিশ্ব রাজনীতিকে যেভাবে নাড়া দিয়েছিল তাতে দেশীয় রাজনীতির অনেক ধারা পাল্টে গেছে। আমেরিকানরা ওয়ার এন টেররের নামে মধ্যপ্রাচ্য এবং দক্ষিণ এশিয়ার দুটি দেশে আক্রমণ করে, যার জের এখনও চলছে। ইদানীংকালে আফগানিস্তানে সেটার পরিসমাপ্তি হলেও দেশটির রূপ সম্পূর্ণভাবে বদলে গেছে।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ইমতিয়াজ আহমদ এই প্রতিবেদককে বলেন, ‘আমেরিকার আফগানিস্তান থেকে বিদায় বড় পরিবর্তন। যা হওয়া উচিত ছিল না একেবারেই। যদিও ওসামা বিন লাদেন সেখানে ছিল কিন্তু একজন ব্যক্তিকে ধরার জন্য আমেরিকা একেবারে পুরো আফগানিস্তান তছনছ করে দিল। হিসাব করে অনেকেই বলছে যে ১ লাখ ৭০ হাজারেরও বেশি মানুষ মারা গেছে, দুই দশমিক আট মিলিয়ন ডলার খরচ হয়েছে, একটা মানুষকে ধরার জন্য যদি এমন করা হয় তবে তা দুঃখজনক।’
অধ্যাপক ইমতিয়াজ আহমদ বলেন, ‘ওসামা বিন লাদেনই যে টুইন টাওয়ার হামলা করেছিল তার সুনির্দিষ্ট প্রমাণ পাওয়া যায়নি। ওসামা বিন লাদেন হামলা করুক বা না করুক আফগান জনগণের কেউ তো টুইন টাওয়ার হামলায় ছিল না। টুইন টাওয়ার হামলায় জড়িত ১৭-১৮ জনের মধ্যে বেশিরভাগ সৌদি আরবের। যদি আক্রমণ করতেই হতো তবে সৌদিতে করা যেত কিন্তু সৌদি আমেরিকার বন্ধু, তাই তারা সৌদিতে আক্রমণ করেনি এবং আক্রমণ করলে বৈশি^ক প্রতিক্রিয়াও অন্যরকম হবে। এমন অবস্থায় আমেরিকা ভাবল, আফগানিস্তানে আক্রমণ করলে তো কিছু হবে না, চুনোপুটির ব্যাপার।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আসিফ সাহান বলেন, ‘টেরোরিস্ট মুভমেন্টগুলোর বিস্তার আগেও ছিল যা টুইন টাওয়ার হামলার পর সব জায়গায় ছড়িয়ে গেছে। শুধু ইউরোপেই নয়, যুক্তরাষ্ট্র ও এশিয়াসহ বিশ্বে সরকার কাঠামোর জন্য এখন টেরোরিস্ট মুভমেন্ট ঠেকানো বড় চ্যালেঞ্জ। পলিটিক্যাল ইডিওলজির দিক থেকেও একটা গ্রোথ হয়েছে বা সন্ত্রাসের বিস্তার ঘটেছে। গণতান্ত্রিক যে শাসনব্যবস্থা সেটারও একটা বিশ্বব্যাপী পাল্টা চ্যালেঞ্জ চলে আসছে। ওয়ার্ল্ড পলিটিক্যাল ইনস্টিটিউট এই বিষয়ে কীভাবে ডিল করবে সিদ্ধান্ত নিতে পারছে না।’
জঙ্গিবাদের বিস্তার বেড়েছে
সাবেক পররাষ্ট্র সচিব তৌহিদ হোসেন এই প্রতিবেদককে বলেন, ‘এই ঘটনায় জঙ্গিবাদ বেড়েছে না কমেছে তা বলা কঠিন। তবে বিশ্বব্যাপী জঙ্গিবাদ নির্মূলের প্রচেষ্টা বেড়েছে। ইরাক ও সিরিয়ায় যদি যুদ্ধ না হতো তা হলে আইএস বা আইসিস ধরনের জঙ্গি সংগঠনগুলোর উত্থান ঘটত না। আইএসের উত্থানের পেছনে ইসরাইলকে দায়ী করা হয়। কারণ আইএস বা আইসিস এখন পর্যন্ত কোনো ইসরাইলি স্বার্থে আঘাত করেনি, এটা রেকর্ডেড। তাদের যত আঘাত এসেছে তার সবই মুসলমান সমাজ ও দেশের বিরুদ্ধে।’
অধ্যাপক ইমতিয়াজ আহমদ এই প্রতিবেদককে বলেন, ‘জঙ্গিবাদের বিষয়ে প্রয়োজন জনগণের সচেতনতা বাড়ানো। কিন্তু প্লেন থেকে বোমা ফেলে তো জঙ্গিবাদ নির্মূল করা যায় না। বরং মানুষের সমস্যাগুলো যদি সমাধান করে এবং জনগণের যদি চিন্তাশক্তি বাড়ানো যায়, তখন সেটা বেটার পলিসি দেন এই বোমা মেরে সন্ত্রাস থামানো। গত ২০ বছরে এই অভিজ্ঞতা হয়েছে। এখন দেখা যাক ভবিষ্যতে আমেরিকা যুদ্ধের ক্ষেত্রে কী পলিসি নেয়। আমেরিকার ইতিহাসে মাত্র ২২ বছর তারা যুদ্ধের বাইরে ছিল। সেই হিসেবে আমেরিকার যে মিলিটারি কমপ্লেক্স তারা কী করবে তা দেখার বিষয়।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আসিফ সাহান বলেন, ‘সন্ত্রাসবাদ বা জঙ্গিবাদ আগেও ছিল কিন্তু টুইন টাওয়ার হামলার পর বিস্তার আরও বেড়েছে।’
বাংলাদেশে যে প্রভাব পড়েছে
সাবেক পররাষ্ট্র সচিব তৌহিদ হোসেন বলেন, ‘জঙ্গিবাদ ইস্যুতে বাংলাদেশ পশ্চিমাদের সতর্ক নজরে (স্ক্রুটিনি) এখনও রয়েছে। যে কারণে আমাদের সরকারকে সবসময়ই সচেষ্ট থাকতে হয়েছে পশ্চিমা বিশ্বকে আশ্বস্ত করতে যে, না আমাদের এখানে কোনো আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসের যোগাযোগ নেই এবং আমরা এই বিষয়ে জিরো টলারেন্স। এই ইস্যুতে আমেরিকানদের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক বেড়েছে এই কারণে যে তারা নিশ্চিত হতে চায় যে এখানে সন্ত্রাসবাদের কোনো যোগসূত্র নেই।’
অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল এবং বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব পিস অ্যান্ড সিকিউরিটি স্টাডিজের (বিআইপিএসএস) সভাপতি আ ন ম মুনিরুজ্জামান বলেন, ‘সন্ত্রাসের যে প্রভাব সারাবিশ্বে লেগেছিল তা থেকে বাংলাদেশও বাদ যায়নি। বাংলাদেশেও সন্ত্রাসীগোষ্ঠীর জন্ম হয়েছে এবং কর্মকাণ্ড ঘটেছে। আমাদের নিরাপত্তার ওপর যে হুমকি এসেছিল তা এখনও বজায় আছে। যার রূপটা বা ধরনটা মাঝেমধ্যে পাল্টে যায়। বাংলাদেশ এখনও সন্ত্রাসের বিরুদ্ধেই আছে। ইদানীংকালে আফগানিস্তানে যে ঘটনা ঘটেছে তার প্রভাবে আমরা বিশেষভাবে উদ্বিগ্ন। আশঙ্কা হচ্ছে যে এই ধরনের কর্মকাণ্ডের প্রভাবও বাংলাদেশে লাগতে পারে। আমাদের সজাগ থাকা প্রয়োজন।’
তিনি আরও বলেন, ‘শুধু যুক্তরাষ্ট্র নয়, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের বিভিন্ন দেশের সঙ্গে বাংলাদেশ সন্ত্রাসবিরোধী কর্মক্ষমতা বাড়াতে যোগাযোগ রক্ষা করে চলছে এবং বিভিন্ন দ্বিপাক্ষিক এবং বহুপাক্ষিক সহযোগিতার ক্ষেত্র স্থাপন হয়েছে। যেমন যুক্তরাষ্ট্র, ভারত ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের অনেক দেশের সঙ্গে সহযোগিতার ক্ষেত্র স্থাপন হয়েছে। এ ধরনের বৈশি^ক যে কাঠামো আছে সেখানেও বাংলাদেশ সক্রিয়ভাবে সহযোগিতা করছে।’
অধ্যাপক আসিফ সাহান বলেন, ‘বাংলাদেশে জেএমবি বা আনসারুল্লাহ বাংলা টিম বা এআই বা নিউ জেএমবি’র ক্ষেত্রে টুইন টাওয়ার নতুন মোটিভেশন হিসেবে কাজ করেছে। আশির দশকে আল কায়েদা যখন তাদের ঘোষণাপত্র স্বাক্ষর করে এবং প্রকাশ করে তখন সেখানে একজন বাংলাদেশিরও স্বাক্ষর ছিল। আনসারুল্লাহ বাংলা টিম এখন সরাসরি একিউআইএসের (আল কায়েদা ইন সাউথ এশিয়া) সঙ্গে যুক্ত। তারা বাংলাদেশে একিউআইএসের শাখা হিসেবেই পরিচয় দেয়।’
/জেডও/