ই-পেপার বিজ্ঞাপনের তালিকা শনিবার ২৩ সেপ্টেম্বর ২০২৩ ৭ আশ্বিন ১৪৩০
ই-পেপার শনিবার ২৩ সেপ্টেম্বর ২০২৩
https://www.shomoyeralo.com/ad/Amin Mohammad City (Online AD).jpg

https://www.shomoyeralo.com/ad/780-90.jpg
ঐতিহ্যগত জ্ঞান সংরক্ষণ ও বিকাশে ‘আদিবাসী’ নারীদের ভূমিকা
সোহেল হাজং
প্রকাশ: সোমবার, ৮ আগস্ট, ২০২২, ১১:৫৩ পিএম | অনলাইন সংস্করণ  Count : 940

৯ আগস্ট জাতিসংঘ ঘোষিত আন্তর্জাতিক আদিবাসী দিবস। জাতিসংঘ এবার দিবসটির প্রতিপাদ্য বিষয় নির্ধারণ করেছে “দ্যা রোল অব ইন্ডিজেনাস উইমেন ইন দ্যা প্রিজারভেশন এন্ড ট্রান্সমিশন অব ট্রেডিশনাল নলেজ”। বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরাম এর সঙ্গে সঙ্গতি রেখে প্রতিপাদ্য বিষয় নির্ধারণ করেছে “ঐতিহ্যগত বিদ্যা সংরক্ষণ ও বিকাশে আদিবাসী নারী সমাজের ভূমিকা”। বিভিন্ন কারণেই এবার এ দিবসের প্রতিপাদ্যটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের পরিবেশে ও জীববৈচিত্র্য রক্ষায় ‘আদিবাসী’ নারীদের অসামান্য অবদান রয়েছে, সেদিকে গুরুত্ব দেওয়ার কথা বলেছে জাতিসংঘ।
 
জাতিসংঘের মতে, বিশ্বের ৯০টির বেশি দেশে প্রায় ৪৭৬ মিলিয়ন আদিবাসী বাস করে। পৃথিবীতে মোট ভাষার সংখ্যা প্রায় ৭০০০টি। তার মধ্যে আদিবাসীদের ভিন্ন ভিন্ন ভাষা ও সংস্কৃতির সংখ্যাই প্রায় ৫০০০টি। 

বাংলাদেশে ষষ্ঠ জনশুমারি অনুসারে, ‘আদিবাসীদের’ মোট জনসংখ্যা ১৬,৫০,১৫৯ জন, যারা দেশের মোট জনসংখ্যার মাত্র ১%। কিন্তু বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরাম ও আদিবাসীদের অন্যান্য সংগঠন বলছে, এদেশে তাদের লোকসংখ্যা কমপক্ষে ৩০ লক্ষাধিক এবং এদেশে আদিবাসীদের ভাষার সংখ্যা প্রায় ৪০টি। আদিবাসীদের সঠিক জনসংখ্যা জানা যতটা জরুরি তাদের আর্থ-সামাজিক অবস্থার বিভাজিত (ডিসএগ্রিগেটেড) তথ্য জানাটাও জরুরি। আদিবাসীসহ পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর আলাদাভাবে আর্থ-সামাজিক বিষয়ে বিভাজিত তথ্য প্রকাশ করা সম্ভব না হলে তাদের জন্য ন্যায়সঙ্গত উন্নয়ন পরিকল্পনাও হাতে নেওয়া কঠিন হবে। যার ফলে আদিবাসীরা পেছনেই পড়ে থাকবে।

যা হোক, হাজার হাজার বছর ধরে আদিবাসীরা তাদের সমাজ কাঠামোয় প্রকৃতির পরিবেশকে লালন পালন করে আসছে। ভূমিকে তারা মা হিসেবে শ্রদ্ধা করে। ভূমিকে বেচাকেনার পণ্য হিসেবে তারা কখনই ভাবতে চায় না। বরং তারা প্রকৃতির ভূমিকে রক্ষা করে, বন্যপ্রাণীকে সম্মান করে এবং প্রজন্মের পর প্রজন্ম এই ঐতিহ্যগত ধারা পালন করে আসছে। আর এসব ঐতিহ্যগত কাজে আদিবাসী নারীদের প্রধান রক্ষাকারী বলা যায়। তারা আদিবাসীদের ঐতিহ্যগত জ্ঞান সংরক্ষণ ও বংশ পরম্পরায় প্রেরণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। আবার ভূমি ও জীববৈচিত্র্য রক্ষায় অবদান রাখার পাশাপাশি গুটিকয়েক আদিবাসী নারী এখন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়েও আদিবাসী অধিকারের পক্ষে নেতৃত্ব দিচ্ছেন। 

আন্তর্জাতিক আদিবাসী দিবস উপলক্ষে জাতিসংঘের মহাসচিব তার বাণীতে বলেছেন, আমরা ঐতিহ্যগত জ্ঞান সংরক্ষণ ও বিকাশে আদিবাসী নারীদের অবদানকে গুরুত্ব সহকারে তুলে ধরছি। আদিবাসী নারীরা ঐতিহ্যগত খাদ্য ব্যবস্থা এবং ঐতিহ্যগত ওষুধপত্র, আদিবাসী ভাষা ও সংস্কৃতিসহ ঐতিহ্যগত জ্ঞানের রক্ষক। তিনি এই আন্তর্জাতিক দিবসে, জাতিসংঘের সকল সদস্য রাষ্ট্রকে আদিবাসী অধিকার সংক্রান্ত জাতিসংঘের ঘোষণাপত্র বাস্তবায়নের এবং সকলের সুবিধার্থে আদিবাসীদের ঐতিহ্যগত জ্ঞান প্রচার করার আহ্বান জানিয়েছেন। 

সুতরাং বিশ্বে পরিবেশ রক্ষায় আদিবাসীদের অবদান অনস্বীকার্য। আদিবাসীরা বিশ্বের জনসংখ্যার পাঁচ শতাংশেরও কম কিন্তু তারাই বিশ্বের সবচেয়ে দরিদ্র জনসংখ্যার ১৫ শতাংশ। আবার বিশ্বের এই ৫ শতাংশ আদিবাসীই, বিশ্বের জীববৈচিত্র্যের ৮০ শতাংশ রক্ষা করে চলেছে বলে তথ্য পাওয়া যায়। আদিবাসীদের সামাজিক, সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক বৈশিষ্ট্যগুলি তাদের প্রভাবশালী সমাজগুলির থেকে স্বতন্ত্র। তারা তাদের এই স্বতন্ত্র সংস্কৃতি, পরিচয় এবং জীবনধারার কারণে প্রায়শই নানা বৈষম্যের সম্মুখীন হয়ে থাকে, তারা কখনো কখনো নিজ ভূমি থেকে উচ্ছেদের শিকার হয় এবং দারিদ্র্য ও প্রান্তিকতার দ্বারা অসমভাবে প্রভাবিত হয়।
  
বাংলাদেশেও এর ব্যতিক্রম নয়। আদিবাসী নারীরা সমাজে ও রাষ্ট্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করা সত্ত্বেও, তারা প্রায়শই লিঙ্গ, শ্রেণি, জাতিগত এবং আর্থ-সামাজিক অবস্থার ভিত্তিতে নানা বৈষম্যের শিকার হয়। শিক্ষা, চাকরি ও রাজনৈতিক জীবনে তাদের সীমিত অংশগ্রহণ ও নানা বৈষম্য লক্ষ্য করা যায়। কিন্তু তার চেয়েও বড় উদ্বিগ্নের কারণ হলো- আদিবাসী নারীরা ব্যাপকভাবে নিরাপত্তার শঙ্কায় দিনাতিপাত করে। 
 
কারণ আদিবাসী নারী কিংবা আদিবাসী নারী সমাজের ওপর যুগ যুগ ধরে পারিবারিক, সামাজিক, সাম্প্রদায়িক ও রাষ্ট্রীয় বৈষম্য, বঞ্চনা ও নিপীড়ন চলে আসছে। আমরা পত্রিকা খুললেই কোথাও না কোথাও নারীদের প্রতি সহিংসতার খবর পাই। পাহাড় ও সমতলের আদিবাসী নারী ও শিশুদের ওপর এসব সহিংসতার খবরের সংখ্যাও কম নয়। 

কাপেং ফাউন্ডেশনের তথ্যমতে, বাংলাদেশের আদিবাসী নারীদের ওপর সহিংসতার মাত্রা উদ্বেগজনক হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। 

একজন আদিবাসী নারী বেশ কয়েকটি কারণে এদেশে ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে। প্রথমত একজন নারী হওয়ার কারণে, দ্বিতীয়ত আদিবাসী বা আদিবাসী নারী হওয়ার কারণে, তৃতীয়ত প্রত্যন্ত অঞ্চলে বসবাসের কারণে, চতুর্থত দরিদ্রতার কারণে তারা আরেও বেশি বৈষম্যের শিকার হয়। এসব সহিসংতামূলক ঘটনার সুষ্ঠু বিচার হয় না কিংবা খুবই কম ন্যায়বিচার সংঘটিত হয় বলেই আদিবাসী নারী ও শিশুর প্রতি সহিংসতার ঘটনা এদেশে বার বার ঘটেই চলেছে।  

এদেশের পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য রক্ষায় যে আদিবাসী নারীদের অসামান্য অবদান রয়েছে, রাষ্ট্র তা স্বীকার করতে এগিয়ে আসে না। আদিবাসীদের চিরাচরিত জ্ঞান ও ঐতিহ্যগত ওষুধ সংরক্ষণ ও পরবর্তী প্রজন্মের কাছে এসব প্রেরণ করার কাজ আদিবাসী নারীরাই শত শত বছর ধরে আসছে। আদিবাসীদের পোশাক, খাদ্যাভ্যাস ও ভাষা সংরক্ষণে তাদেরই প্রধান অবদান। এই ভয়াবহ কোভিড-১৯ মহামারিতেও আদিবাসী নারীরা তাদের পরিবারকে সর্বোচ্চ ক্ষতি থেকে রক্ষা করার কাজে ভূমিকা রেখেছে। যখন দেশের বাজারে রান্নার তৈল সংকট দেখা দিচ্ছিল বা সয়াবিন তেলের দাম অত্যধিক হারে বেড়ে গিয়েছিল তখনও তেলবিহীন আদিবাসীদের ঐতিহ্যগত পদ্ধতিতে রান্না করে আদিবাসী নারীরা সংসারে তেলের শূন্যতা বুঝতে দেয়নি। 

আদিবাসী নারীদের এসব গুণ থাকা স্বত্বেও দেশের আজ প্রতিটি স্তরেই তাদের অত্যন্ত অবহেলার শিকার হতে হয়। দেশের শাসনকাঠামোর কোনো সিদ্ধান্তগ্রহণের জায়গায় তাদের রাখা হয় না। বাংলাদেশ সংসদে নারীদের ৫০টি সংরক্ষিত আসন বরাদ্দ থাকলেও আদিবাসী নারীদের জন্য সুনির্দিষ্ট করে একটি আসনও নেই। স্থানীয় সরকারের প্রতিষ্ঠানগুলোতে মহিলা ভাইস-চেয়ারম্যান বা মহিলা সদস্য নামে সংরক্ষিত পদ থাকলেও আদিবাসী নারীদের অভিগম্যতা সেখানে নেই বললেই চলে। 

যে আদিবাসী নারীরা শতশত বছর ধরে তাদের ঐতিহ্যগত জ্ঞানের ব্যবহার দ্বারা ভূমি, বন ও প্রাকৃতিক সম্পদ সংরক্ষণ করে আসছে সেই ভূমিতে যখন দেশীয় ও বিদেশি কোম্পানিগুলো কোনো উন্নয়ন প্রকল্প বা পর্যটনকেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করার সিদ্ধান্ত নেয় তখন আদিবাসী নারী তো দূরের কথা স্থানীয় কোনো আদিবাসী নেতৃবৃন্দের পূর্বাবহিত, স্বাধীন সম্মতি গ্রহণ করা হয় না। যা আইএলও কনভেনশন নম্বর ১০৭, এবং ১৬৯, আদিবাসী অধিকার সংক্রান্ত জাতিসংঘের ঘোষণাপত্র ২০০৭ ও নানা আন্তর্জাতিক ও জাতীয় আইনের পরিপন্থী। 

সম্প্রতি বান্দরবান জেলার চিম্বুক পাহাড়ে ম্রো আদিবাসী এলাকায় ম্যারিয়ট ফাইভ স্টার হোটেল নির্মাণ ও সমতলের মধুপুর গড় অঞ্চলে গারো আদিবাসী এলাকায় বনবিভাগের কৃত্রিম লেক স্থাপনে আমরা এমনটাই চিত্র দেখতে পাচ্ছি। শতশত বছর ধরে যে আদিবাসীরা তাদের ভূমিকে রক্ষা করে আসছে তাদের ভূমিকে সংরক্ষিত বনাঞ্চল, খাসভূমি ঘোষণা দিয়ে কিংবা রাষ্ট্রের কোনো উন্নয়নের দোহাই দিয়ে উচ্ছেদ করা ঠিক হবে না।

তাই আন্তর্জাতিক আদিবাসী দিবসে সুপারিশ থাকবে আদিবাসীদের ঐতিহ্যগত জ্ঞান ব্যবহার ও প্রচারে রাষ্ট্রীয় উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। আদিবাসীদের আত্মনিয়ন্তণাধিকার ও প্রথাগত ভূমি অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে হবে। আদিবাসী অঞ্চলে কোনো উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণের ক্ষেত্রে অবশ্যই স্থানীয় আদিবাসী নারীসহ সংশ্লিষ্ট আদিবাসী সমাজের স্বাধীন ও পূর্বাবহিত সম্মতি গ্রহণ করতে হবে। আদিবাসী নারীদের জন্য বিশেষ নিরাপত্তার ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে এবং তাদের ওপর সংঘটিত সহিংসতামূলক ঘটনার দ্রুত সুষ্ঠু বিচার করতে হবে। 

লেখক: কেন্দ্রীয় সদস্য, বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরাম।
shohelhajong@gmail.com

https://www.shomoyeralo.com/ad/Local-Portal_728-X-90 (1).gif



https://www.shomoyeralo.com/ad/Google-News.jpg

সর্বশেষ সংবাদ

সর্বাধিক পঠিত


ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: কমলেশ রায়, আমিন মোহাম্মদ মিডিয়া কমিউনিকেশন লিমিটেড
এর পক্ষে প্রকাশক গাজী আহমেদ উল্লাহ
নাসির ট্রেড সেন্টার, ৮৯, বীর উত্তম সি আর দত্ত সড়ক (সোনারগাঁও রোড), বাংলামোটর, ঢাকা।

ফোন : +৮৮-০২-৯৬৩২৩৬৮-৭৪, ফ্যাক্স : +৮৮-০২-৯৬৩২৩৭৫। ই-মেইল : shomoyeralo@gmail.com