ই-পেপার মঙ্গলবার ২২ অক্টোবর ২০২৪
মঙ্গলবার ২২ অক্টোবর ২০২৪

প্রাপ্তি ম্লান করে দেয় অপ্রাপ্তির বেদনা
প্রকাশ: শুক্রবার, ৩০ ডিসেম্বর, ২০২২, ৮:২০ এএম  (ভিজিট : ৭৪০)
আমাদের সব প্রাপ্তিতে অপ্রাপ্তির বেদনা থাকে। প্রাপ্তিগুলো যত বৃহৎ, বেদনাগুলো ততই মহৎ। ফলে বিশেষ অর্জন, প্রাপ্তি আর আনন্দের দিনে আমরা তা নিরঙ্কুশ উদযাপন করতে পারি না। এ বোধহয় এই জনপদের মানুষের নিয়তি। গ্রিক বীরদের জন্য যা অনতিক্রম্য ছিল। আমাদেরও যেন তাই।

২৮ ডিসেম্বর ছিল বাংলাদেশের জন্য একটা বিশেষ দিন। যাতায়াতের ক্ষেত্রে রাজধানী ঢাকা একটি যুগান্তকারী ইতিহাস স্পর্শ করল সেদিন। উন্নত দেশের উন্নত যোগাযোগব্যবস্থার মতো বাংলাদেশ দ্রুতগামী মেট্রোরেলের যুগে প্রবেশ করল। যানজটের জন্য কুখ্যাত শহর ঢাকার জন্য সত্যিকার অর্থে এটি আশা-জাগানিয়া ব্যাপার। যে ঢাকা দিনে দিনে এক ঘিঞ্জি শহরে পরিণত হয়েছে- পেশার খাতিরে, শিক্ষার খাতিরে, চিকিৎসার খাতিরে সারা দেশ থেকে মানুষ গিয়ে জমা হয় ঢাকায়। অনেকটা সারা শরীরের রক্ত মুখে গিয়ে জমা হওয়ার মতো অসুস্থ এই প্রবণতা। যারা রাজধানীমুখী হন কিংবা হতে বাধ্য হন তারা জানেন। এ এক অদ্ভুত দেশ, যেখানে সবকিছু গড়ে ওঠে, বেড়ে ওঠে পরিপুষ্ট হয় ঢাকাকেন্দ্রিক। তিনটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের কথা উল্লেখ করলাম। অগুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো যদি ধরেন ভালো কোনো পণ্য কিনতে চান ঢাকার মার্কেট ছাড়া উপায় নেই, মুভি দেখা কিংবা পার্কের মতো বিনোদন চান ঢাকা ছাড়া দ্বিতীয় কোনো শহর নেই। 

এই বহুবিধ কারণে ঢাকাবাসী হয়ে মানুষ ঢাকায় গিয়ে বন্দি হয় বহুবিধ খাঁচায়। সবচেয়ে বড় খাঁচাটির নাম যানজট, যা তার দিনের অধিকাংশ সময়টুকু গিলে খায়। গিলে খায় মানুষের অবসর, বিনোদন কিংবা বিশ্রামের সময়। এই যানজট যে কত মানুষের জীবন নিয়েছে হাসপাতালে পৌঁছার আগেই অ্যাম্বুলেন্সে, পরীক্ষার্থী কিংবা চাকরিপ্রার্থীকে পৌঁছাতে দেয়নি হল পর্যন্ত। হয়তো সময়মতো পৌঁছাতে পারেনি বলে কত প্রেমিক-প্রেমিকা ভুল বুঝে দূরে সরে গেছে! মূলত এ তালিকা না ফুরানো। রাজধানী ঢাকার অভিশাপ যানজট।

না, যানজটের শহরে এই মুহূর্তে যানজটের কারণ অনুসন্ধান এই লেখার উদ্দেশ্য নয়। বরং এই মেট্রোরেলের মাধ্যমে রাজধানীবাসী যে নতুন যুগে প্রবেশ করেছে, বিরাট এক অভিশাপ থেকে মুক্তি পাওয়ার স্বপ্ন দেখছে, এটাই আমার বলার বিষয়। 

মূলত ঘনবসতিপূর্ণ শহরগুলোতে জনসাধারণের চলাচলের জন্য মাটির নিচে কিংবা ওপরে এই দ্রুতগামী যান ছাড়া দ্বিতীয় কোনো বিকল্প নেই। মানুষ নানা প্রয়োজনে ঘরের বাইরে যাবে, ধারণক্ষমতার অধিক মানুষের চলাচলের জন্য যে রাজপথ, গলিপথ তা মানুষের ভারে স্তব্ধ হয়ে থাকবে, এটাই তো স্বাভাবিক। আমি মাঝেমধ্যে ঢাকার রাস্তায় যানজটে আটকে থাকা মানুষের নির্বিকারত্ব দেখে ভাবি কী অসীম ধৈর্য রাজধানীবাসীর। এই মেট্রোরেল যে কত কত সমস্যার সমাধান করে দিল রাজধানীবাসীর। আজ-কালের জন্য নয়, শত বছরের জন্য।

রাজধানীর যাতায়াতের এই বিশাল পরিবর্তনের সময় আমাদের মূল আলোচ্য হয়ে উঠল মেট্রোরেলের চালক। মারিয়া আফিজা। নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কেমিস্ট্রি অ্যান্ড কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিষয়ে স্নাতকোত্তর মেয়েটি কেন চালক হতে গেল। ধান ভানতে শিবের গীতের মতো আমাকে ফিরতে হয় জাতির এই দুর্ভাগ্যের কাছে। 

ছোটবেলায় আমরা রচনা লিখতাম এইম ইন লাইফ। এইম ইন লাইফ লিখতে আমরা শিক্ষার্থীরা জানতাম না আসলে আমরা কী হতে চাই। বই থেকে মুখস্থ লিখে দেওয়াই ছিল কাজ। আর সেই এইম অধিকাংশই ডাক্তার হয়ে জনসেবাতেই সীমাবদ্ধ। সীমাবদ্ধ মানে আমাদের সৃজনশীল চিন্তার সীমাবদ্ধতা। আমরা যে সিস্টেমের দাস, সেই সিস্টেম আমাদের নিজের ভেতর থেকে নিজেকে চিনতে সহায়তা করে না। আমরা আমাদের অন্তর্নিহিত গুণ বা প্রতিভার সন্ধানই পাই না আজীবন। ফলে যে শিক্ষায় আমরা শিক্ষিত হই সে শিক্ষা আমাদের কোনো কাজে লাগে না। যে শিক্ষা আমরা অর্জন করি তা হয়তো কোনো কাজেরই না। 

এ এক অনিবার্য নিয়তি জাতির। মেধা, প্রতিভা আর শিক্ষা ও সময়ের অপচয়। বুয়েটের ছাত্র হচ্ছে ব্যাংকার, ম্যানেজমেন্টের ছাত্র হচ্ছে ম্যাজিস্ট্রেট। কোথায় থাকে ছাত্রজীবনে লেখা এইম ইন লাইফের এইম, কোথায় থাকে নিজের ভেতরে অঙ্কুুরিত এইম! ইচ্ছা-অনিচ্ছার বাইরে এই শিক্ষা আর কর্মের যোজন যোজন দূরত্ব অধিকার বা ইচ্ছা নয়, সুযোগের ওপর নির্ভরশীল। শিক্ষা যে জাতির সুযোগের ওপর নির্ভর করে চলে সেই জাতির কেমিকেল অ্যান্ড কেমিস্ট্রির ছাত্রী মেট্রোরেলের ড্রাইভার হলে অবাক হওয়ার কী আছে? এ কি নতুন কিছু? 

স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী পার হলো। আমরা এখনও আমাদের শিক্ষানীতিই সুনির্দিষ্ট করতে পারিনি। যে নীতিতে নির্ধারিত হয় জাতির সাংস্কৃতিক ও মানবিক ভবিষ্যৎ। গড়ে ওঠে জাতির ভবিষ্যৎ।

আমার এক বন্ধু সম্প্রতি আমেরিকা প্রবাসী। মেয়ে ঢাকার নামকরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পড়াশোনা করত। ও মাঝে মাঝে আমার সঙ্গে অভিজ্ঞতা শেয়ার করে। ওখানকার বাচ্চারা ঘুম থেকে উঠে স্কুলে যাওয়ার জন্য ব্যস্ত হয়ে যায়। অথচ ওর বাচ্চা স্কুলে যাওয়ার সময় হলেই বলত পেটে ব্যথা। আমি তখন আমার সন্তানদের কথা ভাবি। আমাদের সন্তানেরা বড় অভাগা। 

দশ বছরের শিক্ষাজীবনের একটি দিন তারা স্কুলজীবন উপভোগ করেনি। আমার বাঁহাতি ছেলে ৭ বছর বয়সে বিদ্যালয়ের প্রথম দিন বাঁহাতে খাতা নেওয়ার অপরাধে স্যারের থাপ্পড় খেয়ে গালে কালশিটে দাগ নিয়ে বাড়ি ফিরেছে। এরপর কোনো দিন আর সে স্কুলজীবনকে ভালোবাসতে পারেনি। এই সেদিনও সহপাঠীদের সঙ্গে ঝগড়া করার অপরাধে পরীক্ষার হলে শোকজ ধরিয়ে দিয়ে এসেছে। পরীক্ষার হলে নার্ভাস হয়ে বমি করে অসুস্থ। এই পরীক্ষানির্ভর শিক্ষাব্যবস্থায় শিক্ষক একবারও ভাবেননি একজন ছাত্রকে পরীক্ষার হলে এই মানসিক নির্যাতন করা যায় কি না! 

এ আরেক অদ্ভুত ব্যবস্থা। পরীক্ষানির্ভর এই ব্যবস্থায় কোনো কারণে একবার পরীক্ষা খারাপ হলে তার গুরুশাস্তি বহন করে যেতে হবে সারা জীবন। বাকি জীবনে আরও অসংখ্যবার মেধা-যোগ্যতার প্রমাণ দিলেও তার এক পরীক্ষা খারাপের ক্ষতি আর পোষাবে না। অথচ এই যে পরীক্ষা পদ্ধতি অসংখ্য ত্রুটিতে ভরা। শিক্ষাক্রমের আদর্শ উদ্দেশ্য-লক্ষ্যহীন। পাঠ্যপুস্তক বিতর্কাতীত নয়। প্রশ্নপত্রে অসংখ্য ভুল। আর আমাদের শিক্ষক কুল! বলা বাহুল্য। তাদের অধিকাংশই জানে না শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কী ব্যবহার করতে হয়। আমি অধিকাংশ শিক্ষককে দেখি ছাত্রদের তুই বলে অশালীন তুচ্ছার্থক ব্যবহার করেন। তাদের নিয়ে নিজের ব্যক্তিগত কাজ করান। সিগারেট কিনিয়ে আনাতেও দেখি ভূরি ভূরি। কথায় কথায় গায়ে হাত তোলা তো ডালভাত। শিক্ষকতার পেশায় নিয়োজিত লোকগুলোর যদি উন্নত শিক্ষা-কাঠামোর নিরিখে যোগ্যতার পরিমাপ করা হয় আমি জানি খুব তাদের যোগ্যতার প্রমাণ দিতে পারবেন। এই অযোগ্য শিক্ষকেরা হরেদরে ক্লাস ফাঁকি দিতে থাকেন, টাকার বিনিময়ে প্রশ্নপত্র ফাঁস করে দেন, প্রাইভেট পড়ানোর জন্য ক্লাসে পাঠদান করেন না। আমাদের অতি মেধাবী প্রজন্ম জেনে ফেলে তাদের শিক্ষকদের এই ফাঁকিবাজি। তারপরও সোকল্ড শিক্ষকরা তাদের কাছে আশা করেন সর্বোচ্চ শ্রদ্ধা। আর না পেলে হায় হায় রব তোলেন, গেল গেল প্রজন্ম গেল। মূল্যবোধ বলতে কিছুই আর রইল না। 

মূল্যবোধ তো এক আপেক্ষিক বিষয়। যুগ আর কালের প্রয়োজনে যা বদলায়। দুশ বছর আগের ঔপনিবেশিক আমলে কিংবা তারও আগের সামন্তযুগের মুখ বুজে সয়ে যাওয়া প্রজন্ম এই ডিজিটালাইজেশনের যুগে আশা করা যে ভুল আমাদের অধিকাংশ শিক্ষকের সেই বোধটুকুই নেই। এই ভার্চুয়াল জগতের সন্তানেরা আমাদের চেয়ে দ্রুতগতিতে পৃথিবীকে জেনে নিচ্ছে। আমরা অভিভাবক কিংবা শিক্ষক কেউ তাদের সঙ্গে তাল মেলাতে পারছি না। কিন্তু এই যে তাল মেলাতে পারছি না তা স্বীকারও করতে পারছি না।

আজ যে সন্তানদের নিয়ে কিংবা প্রজন্মকে নিয়ে আমরা হতাশা ব্যক্ত করি তার দায় সর্বাংশে আমাদের অভিভাবক আর শিক্ষকদের। আমরা পরপর কয়েকটি যুগের মানুষ বড় হয়েছি আদর্শহীন-লক্ষ্যহীন হয়ে। রাজনৈতিক অস্থিরতাজাত সামাজিক ভারসাম্যহীনতা এর জন্য দায়ী হতে পারে। কিন্তু এর সুদূরপ্রসারী প্রভাব হয়তো এ দেশ ভোগ করবে আরও কয়েক দশক। 

এর থেকে বের হয়ে আসতে হলেও আরও কয়েক দশকের প্রচেষ্টা দরকার। অথচ যার শুরুটাই এখনও হয়নি। 

ফলত আমরা জানি না আমাদের কাক্সিক্ষত সেই সময় কত দূর! কিংবা আদৌ সেই সময় আমরা ছুঁতে পারব কি না! যে মানবিক বা সাংস্কৃতিক সভ্য সময়ের জন্য উপযুক্ত মানুষ তৈরি না হলে অনেক অর্জন ব্যর্থ হয়ে যেতে পারে। 

মেট্রোরেলের যুগে প্রবেশের এই সময়ে দাঁড়িয়ে আমরা বড় হতাশায় আবিষ্কার করি এই বিশাল ও বিপুল অপ্রাপ্তির বেদনা আমাদের আনন্দিত হয়ে ওঠার মোটাদাগের প্রবণতাকে ব্যাহত করে বারবার। আমাদের সব প্রাপ্তি প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে যায় ভবিষ্যতের মাপকাঠিতে। 

লেখক: সাহিত্যিক




সর্বশেষ সংবাদ

সর্বাধিক পঠিত


ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক : সৈয়দ শাহনেওয়াজ করিম, আমিন মোহাম্মদ মিডিয়া কমিউনিকেশন লিমিটেড এর পক্ষে প্রকাশক গাজী আহমেদ উল্লাহ। নাসির ট্রেড সেন্টার, ৮৯, বীর উত্তম সি আর দত্ত সড়ক (সোনারগাঁও রোড), বাংলামোটর, ঢাকা।
ফোন : +৮৮-০২-৯৬৩২৩৬৮-৭৪, ফ্যাক্স : +৮৮-০২-৯৬৩২৩৭৫ | ই-মেইল : shomoyeralo@gmail.com
close