ই-পেপার শুক্রবার ১৭ মে ২০২৪
শুক্রবার ১৭ মে ২০২৪

তীব্র তাপপ্রবাহে নিজেদের সচেতন হতে হবে
প্রকাশ: শুক্রবার, ৩ মে, ২০২৪, ২:২৭ এএম আপডেট: ০৩.০৫.২০২৪ ৮:০৩ এএম  (ভিজিট : ২৫৭)
বাংলাদেশ ষড়ঋতুর দেশ। এর মধ্যে গ্রীষ্মকাল হিসেবে বাংলা বৈশাখ ও জ্যৈষ্ঠ মাস। অবশ্য চৈত্র মাসে গরম থাকলেও জলীয় পদার্থ কম থাকে বলে অতটা জনজীবন প্রভাবিত করতে পারে না। অবশ্য এ সময় ঠান্ডা ও গরমের লুকোচুরি রোমান্টিক মন আবেগী করে তুলে। আর এ চৈত্র মাস ঋতুবাজ বসন্তকালের আওতাভুক্ত। বস্তুত গ্রীষ্মকালে গরম থাকলেও মৌসুমি বায়ু প্রবাহিত হয় বলে ঝড়-বৃষ্টিসহ স্বাভাবিক বৃষ্টি কম হয় না? কিন্তু এবার ব্যতিক্রম। গ্রীষ্মের প্রথমদিকে কিছুটা থেমে থেমে বৃষ্টি হলেও এখন আর বৃষ্টির দেখা নেই। তাপমাত্রা এমন অবস্থায় দাঁড়িয়েছে যে দেশের চুয়াডাঙ্গায় ৪৩.৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত অতিক্রম করছে। তা ছাড়া বাংলাদেশের ১৭টি অঞ্চলে ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রার বেশি এবং ঢাকা রাজধানীর তাপমাত্রাও ৪১ ডিগ্রি সেলসিয়াস অতিক্রম করেছে। পুরো এপ্রিল মাস ধরে টানা তাপপ্রবাহ চলছে, যা দেশে গত ৭৬ বছরে দেখা যায়নি। শুধু বাংলাদেশ নয়, দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় প্রায় দেশগুলো এ গরম আবহাওয়ার কবলে। মূলত গ্রীষ্মে গরম থাকবে এটিই স্বাভাবিক। আর এ গ্রীষ্মে ঝড়োবৃষ্টির সুবাদে কৃষকের মুখে হাসি ফুটে ওঠে। কেননা এটি ফসলের জন্য উপকারী। একই সঙ্গে এ ঋতুতে আম, কাঁঠাল, জাম, লিচু, ফুটি, তরমুজসহ হরেক রকম সুস্বাদু ফল-ফলাদির সুগন্ধে সব জনপদ মম করে।

অথচ এবার ব্যতিক্রম। শুধু বাংলাদেশ নয়, তীব্র তাপপ্রবাহে পুড়ছে ভারত, পাকিস্তান, নেপাল, ভুটান, মিয়ানমার, কম্বোডিয়া, ভিয়েতনাম, থাইল্যান্ড, শ্রীলঙ্কা, সিঙ্গাপুর, চীন, লাওস, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়াসহ প্রভৃতি দেশ। ইতিমধ্যে বৈজ্ঞানিক গবেষণায় দেখা গেছে যে, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে তাপপ্রবাহ দীর্ঘ, ঘন ঘন এবং দিন দিন আরও তীব্রতর হয়ে উঠছে। আর এর ফলশ্রুতিতে এ প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে অর্থনৈতিক ক্ষতিসহ বহু মানুষ অকালে মারা যাচ্ছে। এর মধ্যে এএফপির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে যে, দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া সবচেয়ে খারাপ তাপপ্রবাহের মধ্য দিয়ে অতিবাহিত করছে। এর সপক্ষে বিশেষজ্ঞরা অভিমত ব্যক্ত করেন যে, কয়েক বছর পরপর গ্রীষ্মমণ্ডলীয় অঞ্চলগুলোয় এল নিনোর প্রভাব দেখা দেয়। বৈশি^ক খরা, তাপপ্রবাহ, ঝড় ও বন্যার মতো যত বিপর্যয় আছে, তার অধিকাংশই ঘটছে এই দক্ষিণ এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বিভিন্ন দেশে।

স্বভাবতই প্রশ্ন উঠতে পারে যে, এল নিনো কী এবং কী এর বৈশিষ্ট্য? এ ব্যাপারে সম্যক ধারণার জন্য এল নিনো সম্পর্কে বলতে গেলে তার বিপরীত লা লিনা সম্পর্কেও বলা সমীচীন বলে মনে করি। বস্তুত এল নিনো স্প্যানিশ শব্দ, যার অর্থ হলো ছোট ছেলে। এটি জলবায়ুর একটি প্যাটার্ন, যা মধ্য ও পূর্ব প্রশান্ত মহাসাগরের সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চ তাপমাত্রা দ্বারা চিহ্নিত। সাধারণত এল নিনো প্রতি ৪-৭ বছর পরপর একবার দেখা যায়। আর গত কয়েক বছর ধরে এ এল নিনো দেখা দিয়েছে এবং যা বেড়েই চলেছে। এর বিপরীত হলো লা নিনা এটিও স্প্যানিশ শব্দ, যার অর্থ হলো ছোট বালিকা। লা নিনা চলাকালীন সময়ে সমুদ্রের গভীর থেকে ঠান্ডা পানি উপরিভাগে উঠে আসে। ফলে ওই প্রশান্ত মহাসাগরের পৃষ্ঠের তাপমাত্রা স্বাভাবিকের চেয়ে ঠান্ডা হয়ে যায়। এ ক্ষেত্রে সহজভাবে যদি বলি, এল নিনো যেমন তীব্র তাপপ্রবাহের কারণ; তেমনি লা নিনা এর উল্টোটা অর্থাৎ ঠান্ডা প্রবাহের কারণ। আর দুটি নামই এ ক্ষেত্রে রূপকভাবে নেওয়া হয়েছে বলে প্রতীয়মান হয়। আসলে এটি সাউদার্ন অসকিলেশন নামক আবহাওয়ার ধরনের দুটি অংশ। এ ক্ষেত্রে এল নিনো উষ্ণায়ন পর্যায় এবং লা নিনা শীতলকরণ পর্যায়কে বোঝায়।

চলমান তাপপ্রবাহ অতীতের সব রেকর্ড ভঙ্গ করেছে। হাসপাতালে ডায়রিয়া, আমাশয়, কাশি ও জ্বরের কারণে রোগীদের ভিড় বাড়ছে এবং প্রতিদিন হিটস্ট্রোকে মৃত্যুর খবর আসছে। এদিকে হিটস্ট্রোকের লক্ষণের ক্ষেত্রে শরীরের তাপমাত্রা বৃদ্ধি, মাথা ব্যথা, ক্ষুধা মন্দা, শারীরিক দুর্বলতা, মাংস পেশিতে ব্যথা ও খিল লাগা, এলোমেলো আচরণ, খিঁচুনি ও মূর্ছা যাওয়া। শুধু মানুষ নয়, পশুপাখির ওপরও এর প্রভাব পড়েছে। গবাদিপশুর গায়ে জ¦র ও পেটে গ্যাসজনিত কারণে অসুস্থ হয়ে পড়ছে এবং দুধ উৎপাদন কমে গেছে। তা ছাড়া গরু ও মুরগিও কম মারা যাচ্ছে না? লিচুর গুটিসহ কচি আমগুলো ঝরে পড়ছে এবং অন্যান্য ফলদ বৃক্ষের একই অবস্থা। আর এ তীব্র খরার কারণে ধানসহ অন্যান্য শস্য চিটা হওয়ার সম্ভাবনা আছে। 

তাপপ্রবাহে বোরো ধানের উৎপাদন হ্রাস পেতে পারে। কেননা উল্লেখযোগ্য পরিমাণ বোরো ধান কৃষকের ঘরে উঠলেও এখনও দেশের বেশ কিছু এলাকায় ধান কাটা হয়নি। এদিকে তীব্র গরমে ধানসহ অন্যান্য ফল-ফলাদি ও ফসলের বড় ক্ষতির আশঙ্কা করছেন কৃষি বিশেষজ্ঞরা। উল্লেখ্য, চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরে সারা দেশে বোরো ধানের আবাদ হয়েছে ৫০ লাখ ৫৮ হাজার হেক্টর জমিতে। যেখানে উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ২ কোটি ২২ লাখ ৫৬৪ টন। তবে চলমান অতি তাপে উৎপাদন নিয়ে শঙ্কা রয়েছে এবার। কেননা, ২০২১ সালে কয়েক ঘণ্টার হিটশকে ৩ লাখ কৃষকের ২১ হাজার হেক্টর জমির ধান নষ্ট হয়েছিল। ধানের জন্য ক্রিটিক্যাল টেম্পারেচার ৩৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস। কিন্তু বেশ কয়েক দিন ধরে বিভিন্ন অঞ্চলে তাপমাত্রা ৪০ ডিগ্রিও ছাড়িয়ে গেছে; যা ধানের জন্য সহনীয় মাত্রার চেয়ে অনেক বেশি। ফলে ধান নষ্ট বা চিটা হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। তা ছাড়া অতিরিক্ত খরায় পাট ও মরিচসহ মাঠের ফসল নিয়ে দুশ্চিন্তায় পড়েছেন চাষিরা। এদিকে দেশের ইতিহাসে এবারের সবচেয়ে ভয়াবহ তাপপ্রবাহে ভূগর্ভের পানির স্তর নিচে নেমে গেছে বেশিরভাগ এলাকায়। অধিকন্তু প্রচণ্ড খরায় নদ-নদী, খাল-বিল ও হাওর-বাঁওড় শুকিয়ে যাচ্ছে। ফলে সব ধরনের কৃষি উৎপাদন ব্যাহত হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। দুঃখের বিষয় হলো যে, এ তাপপ্রবাহে ক্ষেতমজুরসহ দিনমজুর ও খেটে খাওয়া মানুষ কাজ করতে পারছে না বলে আর্থিকভাবে সংকটে পড়েছে।

সারা দেশে প্রবহমান তাপপ্রবাহে জনজীবন হয়ে উঠেছে দুর্বিষহ ও বিপর্যস্ত। এ গরমে ঢাকা রাজধানীর সাধারণ মানুষ, পথচারী, রিকশাচালকসহ বিভিন্ন পেশার মানুষ পার করছেন অসহনীয় দুর্ভোগ। তাদের স্বস্তি দিতে রাজধানীর বিভিন্ন পয়েন্টে বসানো হয়েছে সুপেয় পানির ট্যাঙ্ক। যেমন-মতিঝিল, শাপলা চত্বর, পল্টন, টিএসসি, নীলক্ষেত মোড়, এলিফ্যান্ট রোড, বাটা সিগন্যাল, ফার্মগেট, বিজয়নগর, কারওয়ান বাজার, মগবাজার, গুলশান, গ্রিনরোড, মিরপুর, মোহাম্মদপুর এবং বসুন্ধরা আবাসিক এলাকাসহ আরও বেশ কয়েকটি জায়গা। আর এই মহতী কাজের জন্য এগিয়ে এসেছে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ, ফায়ার সার্ভিস, সিভিল ডিফেন্স ও ঢাকা ওয়াসাসহ বিভিন্ন সরকারি, সামাজিক, রাজনৈতিক স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠান। তা ছাড়া ব্যক্তিগত উদ্যোগেও অনেকে এ সেবা দান করে চলেছেন। এ কার্যক্রম শুধু পানি নয়। পানির সঙ্গে লেবু, চিনি ও স্যালাইন মিশ্রণ করা হয়। আর রাজধানীসহ অন্যান্য শহরাঞ্চলে তৃষ্ণা মেটাতে রাস্তার মোড়ে মোড়ে ঠান্ডা লেবুর শরবত, ডাব, কোল্ড ড্রিঙ্ক ইত্যাদি দেদার বিক্রি হচ্ছে। তা ছাড়া ফ্যান ও এসির দোকানে ক্রেতার চাপ পড়েছে। রাস্তায় তালপাখাও কম বিক্রি হচ্ছে না? কথায় বলে কারও সর্বনাশ, আবার আর কারও পৌষ মাস। আর সেই অবস্থায় দাঁড়িয়েছে লবণচাষি। এ ক্ষেত্রে এই খরা তাদের অনুকূলে গেছে বিধায় চলতি মৌসুমে ২২ লাখ ৩৪ হাজার ৬৫৮ টন লবণ উৎপাদিত হয়েছে, যা গত সব রেকর্ড অতিক্রম করেছে। এতদ্ব্যতীত হাওরের কৃষকরা এবার বাম্পার ফলনের জন্য হাসিমুখে বুক বেঁধে আছে। 

এখন সারা দেশজুড়ে সবার মুখে মুখে একই কথা, এ প্রচণ্ড খরা কতদিন চলবে? কখন বৃষ্টি হবে?

এদিকে গরম থেকে মুক্তির জন্য দেশের বিভিন্ন স্থানে বৃষ্টি প্রার্থনা করে ইসতিসকার নামাজ ও মোনাজাত করা হচ্ছে। এর মধ্যে চলমান তাপপ্রবাহের কারণে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ে স্কুল-মাদরাসার ক্লাস আগামী ২ মে পর্যন্ত বন্ধ রাখার নির্দেশ দিয়েছেন হাইকোর্ট। গত সোমবার দুপুরে শিক্ষা সচিব এবং প্রাথমিক ও গণশিক্ষা সচিবসহ সংশ্লিষ্টদের প্রতি এ নির্দেশ দেন আদালত। পরে বিকালে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের জনসংযোগ কর্মকর্তা কর্তৃক স্বাক্ষরিত এক বিজ্ঞপ্তিতে মঙ্গলবার দেশের ২৭ জেলার সব স্কুল-কলেজসহ সব ধরনের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করা হয়। এর মধ্যে আওহাওয়াবিদরা স্বস্তির কথা শুনিয়েছেন। তারা বলেছেন যে, বড় কোনো পরিবর্তন না হলে ৫-৬ দিনের মধ্যে বৃষ্টিপাতের সম্ভাবনা আছে।

প্রকৃতি তার মতো করে চলে। কোনো সৃষ্টি তথা প্রাণের কী হলো তা হিসাব-নিকাশ করে চলে না। তাই আমাদের প্রকৃতির সঙ্গে সমন্বয় করে চলা সমীচীন। কেননা প্রকৃতির অবদানের কারণে আমরা বেঁচে আছি। কিন্তু আমরা ওসব মনে রাখি না। প্রকৃতিগত পরিবেশকে নিয়ে কি না করছি? এককথায় ছিনিমিনি খেলছি।যেমন-দেদার গাছ কাটছি; নদীর গতিপথ পরিবর্তন করছি; গ্রিন হাউস গ্যাস ক্রমাগত বাড়িয়ে চলছি ইত্যাদি। আমরা পরিবেশকে নষ্ট করে আমরাই আবার সিম্পোজিয়াম ও সেমিনারে লম্বা লম্বা নীতিবাক্য আওরাচ্ছি। শুধু বর্তমানের এ তাপদাহ বা খরা নয়, সবরকম দুর্যোগের নেপথ্যে আমাদেরই কালো হাত আছে। তাই বিশ্বজনীনভাবে আমরা পৃথিবীবাসী কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে যতখানি আমাদের সাধ্য আছে, পরিবেশের প্রতি হুমকি না হয়, সেসব অযাচিত কিছু না করি। গ্রিন হাউস অ্যাফেক্টের কথা জেনেও সে নেতিবাচক কাজ থেকে কতখানি সরে এসেছি, সে প্রশ্নের জবাব আমরা জানি। কাজেই এ ক্ষেত্রে সচেতনতাই আমাদের মুক্তি দিতে পারে।


সাবেক শিক্ষক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

সময়ের আলো/আরএস/ 




https://www.shomoyeralo.com/ad/1698385080Google-News-Update.jpg

সর্বশেষ সংবাদ

সর্বাধিক পঠিত


ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: কমলেশ রায়, আমিন মোহাম্মদ মিডিয়া কমিউনিকেশন লিমিটেড এর পক্ষে প্রকাশক গাজী আহমেদ উল্লাহ
নাসির ট্রেড সেন্টার, ৮৯, বীর উত্তম সি আর দত্ত সড়ক (সোনারগাঁও রোড), বাংলামোটর, ঢাকা।

ফোন : +৮৮-০২-৯৬৩২৩৬৮-৭৪, ফ্যাক্স : +৮৮-০২-৯৬৩২৩৭৫ | ই-মেইল : shomoyeralo@gmail.com
close