আজ বিশ্ব প্রাণী দিবস। তা হলে প্রাণী কারা? যার প্রাণ আছে, সে-ই তো প্রাণী। তবে এই প্রাণিকুলের ভালো-মন্দ দেখভাল করা বা সচেতন করার জন্যই এই দিবস। সে হিসেবে দিবসটি কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। জেনে রাখা ভালো, বিশ্ব প্রাণী দিবস বিশ্বের সমুদয় প্রাণিকুলের অধিকার এবং কল্যাণের জন্য পালন করা একটি আন্তর্জাতিক দিবস। যা প্রতি বছর অক্টোবর মাসের ৪ তারিখে প্রাণীদের সন্ত, সেন্ট এসিসির ফ্রান্সিসের ভোজ উৎসবের সঙ্গে সংগতি রেখে পালন করা হয়।
এ দিবসের মূল লক্ষ্য হচ্ছে-পৃথিবীর প্রতিটি প্রান্তে প্রাণীদের কল্যাণের মাধ্যমে এদের অবস্থার উন্নতি করা। বিশ্ব প্রাণী দিবস উদযাপনের মাধ্যমে প্রাণী কল্যাণ আন্দোলনকে একত্রিত করা, একে আন্তর্জাতিকভাবে জোরদার করে পৃথিবীকে প্রতিটি জীবের জন্য উন্নততর বাসস্থান হিসেবে গড়ে তোলা। জাতি, ধর্ম, বিশ্বাস বা রাজনৈতিক মতাদর্শ নির্বিশেষে দিবসটিকে বিভিন্ন দেশে বিভিন্নভাবে পালন করা হয়। অধিক জনসচেতনতা এবং শিক্ষার মাধ্যমে বিশ্বকে গড়ে তুলে যেখানে প্রাণীদের সংবেদনশীল প্রজাতি হিসেবে গণ্য করা হয় এবং তাদের কল্যাণে প্রাপ্য মনোযোগ দেওয়া হয়।
বিশ্ব প্রাণী দিবস সর্বপ্রথম হেনরিক জিম্মারমেন নামের একজন জার্মান লেখক এবং প্রকাশক মেন্স উন্ড হুন্দ ‘মানুষ এবং কুকুর’ নামের ম্যাগাজিনে প্রকাশ করেছিলেন। তিনি ১৯২৫ সালের ২৪ মার্চ জার্মানির বার্লিন স্পোর্ট প্যালেসে এই দিবস উদযাপন করেন। ৫ হাজারের বেশি লোক এই অনুষ্ঠানে অংশ নিয়েছিল। এই দিবস মূলত বাস্তুসংস্থানবিদ্যার সন্ত, সেন্ট এসিসির ফ্রান্সিসের ভোজ উৎসবের সঙ্গে সংগতি রেখে ৪ অক্টোবর পালন করার কথা ছিল। কিন্তু সেই সময়ে স্থান সংকুলানের কারণে এই দিনে দিবসটি পালন করা হয়নি।
১৯২৯ সালে প্রথমবারের মতো দিবসটি ৪ অক্টোবর পালন করা হয়। প্রথমদিকে তিনি কেবল দিবসটিতে জার্মানি, অস্ট্রিয়া, সুইজারল্যান্ড এবং চেকোস্লোভাকিয়ার অনুসারী লোকজন পান। বিশ্ব প্রাণী দিবস জনপ্রিয়করণের জন্য জিম্মারমেন প্রতি বছর নিরলসভাবে কাজ করে গেছেন। অবশেষে ১৯৩১ সালে ইতালির ফ্লোরেন্সে অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক প্রাণী সুরক্ষা কংগ্রেসে তার উত্থাপন করা প্রস্তাব মতে ৪ অক্টোবরকে ‘বিশ্ব প্রাণী দিবস’ হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। বলা হয়, ১৯৩১ সালে ইতালির ফ্লোরেন্সে বাস্তুসংস্থানবিদের এক সম্মেলনে সংকটাপন্ন প্রজাতিদের সবার দৃষ্টিগোচর করতে বিশ্ব প্রাণী দিবসের প্রচলন করা হয়। প্রাণী সুরক্ষা আন্দোলনকে ঐক্যবদ্ধ করে বর্তমানে বিশ্ব প্রাণী দিবস একটি বৈশ্বিক অনুষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। যেটিকে ২০০৩ সাল থেকে যুক্তরাজ্যভিত্তিক প্রাণী কল্যাণ চ্যারিটি নেতৃত্ব এবং পৃষ্ঠপোষকতা দিয়ে আসছে। দিবসের কথা বাদ দিলেও আমরা মানুষ। নিজেদের সৃষ্টির সেরা জীব বলে দাবি করি। প্রাণিকুলের মধ্যে আমাদের প্রকাশভঙ্গি, বাকশক্তি ও উদ্ভাবনী ক্ষমতা অন্য প্রাণীর চেয়ে ব্যতিক্রম। ফলে আমরা অন্য প্রাণীর ওপর খবরদারি করতে পারি। পুষে রাখতে পারি। চিড়িয়াখানা বানিয়ে আটকে রাখতে পারি। তবে শক্তিশালী প্রাণীর সঙ্গে কৌশল ছাড়া চলতে গেলে আমাদের প্রাণনাশের আশঙ্কা থেকেই যায়। হিংস্র প্রাণীর সঙ্গে বুঝেশুনে চলতে হয়। নিরীহ প্রাণীকে পুষে রাখতে হয়। এই নিয়ন্ত্রণের মধ্যেও প্রাণীর মৌলিক অধিকার ভুলে গেলে চলবে না।
আমরা চাই প্রতিটি প্রাণীর কল্যাণ হোক। প্রাণীবৈচিত্র্যে সমৃদ্ধ হোক। বন ধ্বংস করা বন্ধ হোক। এমনকি প্রাণীর অবাধ বিচরণ নিশ্চিত করতে হবে। সৃষ্টিকর্তা প্রয়োজন ছাড়া একটি প্রাণীও সৃষ্টি করেননি। কেঁচোকে যেমন বলা হয় প্রকৃতির লাঙল। যা জমি উর্বর করতে সাহায্য করে। কুকুর খুব বিশ্বস্ত ও প্রভুভক্ত প্রাণী। এর ঘ্রাণশক্তি প্রবল। উটকে বানানো হয়েছে মরুভূমির জাহাজ হিসেবে। ডলফিন আমাদের মন ভোলানো নাচ দেখায়। ভেড়াকে সৃষ্টি করা হয়েছে পশম উৎপাদক হিসেবে। এভাবে সব প্রাণীই কোনো না কোনোভাবে প্রকৃতির বিশেষ উপকার করে থাকে। সামান্য কীটপতঙ্গও বিনা প্রয়োজনে সৃষ্টি করা হয়নি। কিছু পোকামাকড় মাটির উর্বরতা বৃদ্ধি করে এবং মাটির জৈবিক গুণগতমান বৃদ্ধির মাধ্যমে কৃষিতে সহায়তা করে। পশুপাখিও এসব প্রাণিকুলের অনেক গুরুত্বপূর্ণ সদস্য। তারা কীটপতঙ্গ নিয়ন্ত্রণে, পরাগরেণুকের ভূমিকা পালন করে। এ ছাড়া পশুপাখি মানুষের কাছে বিভিন্ন উপায়ে গুরুত্বপূর্ণ খাদ্যের উৎস হিসেবে পরিবেশন করে এবং কৃষিকাজে বিভিন্ন সার সরবরাহ করে। ফড়িং একটি সুস্থতা নির্দেশক প্রাণী। একটি পরিবেশ কতটা সুস্থ, তা বোঝা যায় ফড়িংয়ের উপস্থিতি দেখে। মশাসহ ক্ষতিকর প্রাণী খেয়ে ফড়িং আমাদের বিভিন্ন রোগ থেকে রক্ষা করে। পাশাপাশি এই শিকারি পতঙ্গ খায় ফসলের পোকা।
ফলে নিশ্চিত করে বলা যায়, পৃথিবীর সব প্রাণীর পরিবেশ সুরক্ষা এবং মনমানসিকতা সুস্থতায় পশুপাখির গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা আছে। প্রকৃতির সব প্রাণীর মধ্যে একটি পরিবেশগত ভারসাম্য আছে বলে মনে হয়। কিছু প্রাণী চক্র থেকে পুষ্টিগুলো আনতে সহায়তা করে। অন্যরা পচন, কার্বন এবং নাইট্রোজেন চক্রকে সহায়তা করে। সব প্রাণী, পশুপাখি, পোকামাকড় এমনকি অণুজীবও প্রাণীসামগ্রীর ভূমিকা পালন করে। সব প্রাণী এবং উদ্ভিদ একে অন্যকে সহাবস্থান করে এবং একে অন্যের ভারসাম্য বজায় রাখে, যা পরিবেশ সুন্দর করেছে। পশুপাখি পালনের চাষ বিশ্বজুড়ে মানুষের উৎপাদিত গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণের ১৮ শতাংশ অবদান রাখে।
কিন্তু উদ্বেগের সঙ্গে লক্ষ করা যায়, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে মানবসৃষ্ট কারণে এ দেশের বিভিন্ন প্রাণী আজ হুমকির সম্মুখীন। ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন ফর কনজারভেশন অব নেচারের (আইইউসিএন) ২০১৫ সালে দেওয়া তথ্য মতে, এখন পর্যন্ত ৩১ প্রজাতির বন্য প্রাণী দেশ থেকে বিলুপ্ত হয়েছে। এ ছাড়া হুমকির মুখে বহু প্রজাতির বন্য প্রাণী। তবে আমাদের প্রাণীবৈচিত্র্যের অনেক তথ্য এখনও অজানা।
অতি প্রাচীনকাল থেকে এ দেশের মানুষের মধ্যে আছে সরীসৃপ জাতীয় প্রাণী, বিশেষ করে সাপের প্রতি ভ্রান্ত ধারণা, কুসংস্কার ও অলৌকিক বিশ্বাস, যা এখনও কাটেনি। দিন যত যাচ্ছে, জনসংখ্যা ততই বাড়ছে। অতিরিক্ত জনসংখ্যার চাহিদা পূরণে মানুষ হাত বাড়াচ্ছে বনের দিকে। খাদ্য চাহিদা পূরণে বেশি ফসলের আশায় নতুন জমি, আবাসস্থল, স্থাপনা-সবকিছুই হচ্ছে প্রাকৃতিক পরিবেশ নষ্ট করে। এতে তৈরি হচ্ছে মানুষ-সরীসৃপ সংঘাত। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই মারা যাচ্ছে সাপ। কখনো কখনো মানুষও। মানুষের আবাসস্থলের আশপাশে ছয় প্রজাতির বিষধর সাপের বসবাস। কিন্তু মানুষ অজ্ঞতার কারণে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই মেরে ফেলে নির্বিষ সাপও। মারা যাচ্ছে পরিবেশের বন্ধু গুইসাপ। আবার প্রায়ই তক্ষক বা কচ্ছপের পাচার ও আটকের সংবাদ পাওয়া যায়। মানুষের ভ্রান্ত ধারণার কারণে তক্ষক প্রাণীটি এখন বিপন্ন। কচ্ছপের সংখ্যা কমতে কমতে এমন অবস্থা দাঁড়িয়েছে যে, এ দেশের ৩০ প্রজাতির মধ্যে ২২ প্রজাতির কচ্ছপ এখন বিপদাপন্ন প্রাণীর তালিকায়।
বিজ্ঞানীদের মতে, প্রাণীবৈচিত্র্য হলো জল, স্থল সব জায়গায় সব পরিবেশে থাকা সব ধরনের জীব এবং উদ্ভিদের বিচিত্রতা। পৃথিবীর ১২ বিলিয়ন প্রাণীর এক ভাগ অংশতেই ৪৯ মিলিয়ন প্রজাতির বিভিন্ন জীবজন্তু এবং উদ্ভিদের বসবাস। এক গবেষণায় দেখা গেছে, ১৯৭০ সালের পর থেকে স্বাদু পানির স্তন্যপায়ী প্রাণী, পাখি, উভচর প্রাণী, সরীসৃপ এবং মাছের সংখ্যা প্রতি বছর গড়ে ৪ শতাংশ হারে হ্রাস পেয়েছে। ১৯৭৪ সালের শুরুতেই বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ অধ্যাদেশ কার্যকর করা হয়েছিল। যে কয়টি দেশ জীববৈচিত্র্য সম্পর্কিত আন্তর্জাতিক কনভেনশনটি বাস্তবায়নের জন্য আইন কার্যকর করেছে, তার মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। ২০১৭ সালেই বাংলাদেশের জাতীয় সংসদে বাংলাদেশ তার ভূখ-ের ৫ শতাংশের বেশি এবং সমুদ্র অঞ্চলের প্রায় ৫ শতাংশ এলাকাকে ‘ঝুঁকিতে থাকা’ এবং ‘সংরক্ষিত অঞ্চল’ হিসেবে ঘোষণা করেছে।
কেননা প্রজাতিভেদে প্রাণীদের বেঁচে থাকার চাহিদা, পরিবেশ, বাস্তুসংস্থানে খাপ খাওয়ানোর ধরন ভিন্ন। আর প্রতিবেশ ব্যবস্থার এই ভিন্নতা তৈরি করেছে জীববৈচিত্র্য। এই বৈচিত্র্যময়তায় এক প্রাণী আরেক প্রাণীর সঙ্গে অবিচ্ছেদ্যভাবে জড়িত। এই বাস্তুতন্ত্র বিভিন্ন জৈব নিয়ামক নিয়ে গঠিত। এর কোনো একটিতে পরিবর্তন হলে আক্রান্ত হয় ওই পরিবেশকে কেন্দ্র করে বেঁচে থাকা প্রাণীরা এবং পুরো বাস্তুতন্ত্র। তাই বিশ্বে প্রতিটি প্রাণী পরস্পরের ওপর নির্ভরশীল। এই বাস্তুতন্ত্রে প্রতিটি প্রজাতির আলাদা আলাদা ভূমিকা আছে। প্রতিটি জীবই কোনো না কোনোভাবে পরিবেশের জন্য গুরুত্বপূর্ণ।
জীবজগতের ভারসাম্য বজায় রাখা ও পরিবেশের সুরক্ষার স্বার্থে সব জীবকেই বাঁচতে দিতে হবে। মানুষ কেবল অন্য প্রজাতির বিলুপ্তির কারণ হচ্ছে না; তাদের কর্মকা- যদি এ ধারাতেই চলতে থাকে, তা হলে আমরা প্রকৃতপক্ষে মানবজাতির বিলুপ্তির দিকেই এগিয়ে যাব। প্রত্যেক জীবের এই পৃথিবীতে বেঁচে থাকার পূর্ণ অধিকার আছে। ১৯৯২ সালে জাতিসংঘের বিশ্ব প্রকৃতির ঘোষণাপত্রে এই চিন্তাধারা স্বীকৃতি পেয়েছে। তাই আমাদের প্রত্যেকের কর্তব্য, প্রতিটি প্রজাতির জীবকে বাঁচিয়ে রাখা। এর জন্য দরকার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা। একই সঙ্গে প্রাণীবৈচিত্র্যের সংরক্ষণ ও গুরুত্ব সম্পর্কে সবাইকে সচেতন করা জরুরি।
গণমাধ্যমকর্মী
সময়ের আলো/আরএস/