চিফ হিট অফিসার শব্দটির সঙ্গে আমাদের মানে আমজনতার হঠাৎ পরিচয় গত বছর। যখন বুশরা আফরিন নামে এক নারীকে ঢাকার চিফ হিট অফিসার হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হলো। প্রথমত এই ‘চিফ হিট অফিসার’ শব্দটির সঙ্গে আমাদের একদমই পরিচয় ছিল না, দ্বিতীয়ত এই পদে নিয়োগ পেয়েছেন একজন নারী যিনি কিনা আবার ঢাকা উত্তরের মেয়র আতিকুল ইসলামের মেয়ে, তৃতীয়ত যে সময়ে এই নিয়োগ সেই সময়ে দেশজুড়ে চলছে তীব্র তাপদাহ।
সব মিলিয়ে আলোচনা তখন তুঙ্গে। মানুষ কেউ কেউ বোঝার চেষ্টা করছিল চিফ হিট অফিসারের কাজটা আসলে কী? কেউ কেউ বোঝার চেষ্টা করছিল কেন এই পদে মেয়রের মেয়েকে নিয়োগ দেওয়া হলো। কেউ বোঝার চেষ্টা করছিল এটি মেয়রের স্বজনপ্রীতি কি না, কেউ আরেক কাঠি বাড়িয়ে আশা করছিল বুঝি এই চিফ অফিসার এমন কোনো অতিলৌকিক পদক্ষেপ নেবেন, যে রাতারাতি রাজধানী ঢাকা সাইবেরিয়ার বরফঢাকা অঞ্চলে পরিণত হবে। আর সবকিছু ছাপিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম সরব ছিল বুশরার স্মার্টনেস আর গ্ল্যামার নিয়ে। চিফ হিট অফিসার কী, কেন, কীভাবে সব আলোচনার আবশ্যিক অনুষঙ্গ হয়ে উঠেছিল বুশরার দৈহিক সৌন্দর্য।
গত এক বছরে উত্থিত এসব অনেক প্রশ্নেরই উত্তর মিলেছে ইতিমধ্যে। বিশ্বের যেসব শহর গ্লোবাল ওয়ার্মিং কিংবা জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বেশি ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে সেই শহরগুলোর জন্য ‘চিফ হিট অফিসার’ নামে একটি পদ তৈরি করা হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক অ্যাড্রিয়েন আর্শট রক ফাউন্ডেশন এবং এক্সট্রিম হিট রেজিলিয়েন্স এলিয়েন্স এই পদটি তৈরি করেছে। তৈরি করেছে প্রাকৃতিক ঝুঁকি মোকাবিলার জন্য।
তাদের কাজ মূলত ঝুঁকিপূর্ণ শহরগুলোর এই হিট মোকাবিলার জন্য গ্রহণ করা সব কার্যকর প্রক্রিয়ায় সহযোগিতা করবে এবং একই সঙ্গে নতুন নতুন কর্মপন্থা গ্রহণ করবে।
মূলত যেকোনো শহরের মেয়র কিংবা সরকার এই তাপ বৃদ্ধির বিষয়টিকে বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে চিফ অফিসার নিয়োগ করতে পারে।
বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকার উত্তর সিটি করপোরেশনের চিফ হিট অফিসার হিসেবে বুশরা ইসলামকে নিয়োগ দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের সংস্থা। যারা এশিয়া অঞ্চলের তাপ বৃদ্ধি নিয়ে কাজ করে। এবং উল্লেখ্য, এশিয়ার আর কোনো দেশেই চিফ হিট অফিসারের পদটি নেই। যুক্তরাষ্ট্রের মিয়ামি ও ফ্লোরিডা, সিয়েরা লিওনের ফ্রিটাউন, গ্রিসের এথেন্স, চিলির সান্তিয়াগো, মেক্সিকোর মনটেরেই এবং অস্ট্রেলিয়ার মেলবোর্নে এই পদটি রয়েছে এবং এই পদে লোকও রয়েছে।
বাংলাদেশে চিফ হিট অফিসার নিয়োগের এক বছর পূর্ণ হয়েছে। মাঝে ঋতু পরিক্রমায় বর্ষা মৌসুম, হয়ে তীব্র শৈত্যপ্রবাহ অতিক্রম করে আবার গ্রীষ্মকাল শুরু হতেই আলোচনার কেন্দ্রে এসেছেন ‘চিফ হিট অফিসার’ বুশরা আফরিন। মধ্য এপ্রিলে সারা দেশে তীব্র তাপপ্রবাহ শুরু হলে দেশজুড়ে ঘোষণা করা হয় হিট অ্যালার্ট। গরমে রাজধানী ঢাকার মানুষের হাঁসফাঁস অবস্থা তখন নতুন করে আলোচনা শুরু হয়েছে বুশরা আফরিনকে নিয়ে। কী করেছেন তিনি এক বছর শহরের হিট কমাতে? কোনো উদ্যোগ নিয়ে থাকলে তার ফলাফল কী?
শুনি হিট অফিসার বুশরা কী বলছেন, তিনি বলেছেন, নগরের তাপমাত্রা ও দূষণ কমাতে বনানী ও কাকলিতে টু অ্যাবল ফরেস্টের প্রজেক্ট গ্রহণ করেছেন। যা একই সঙ্গে শীতলীকরণ, বায়ুদূষণ রোধ এবং মাটির গুণাগুণ বৃদ্ধি করবে। তিনি আরও বলেছেন, এনজিওর সঙ্গে মিলে আরও কিছু কার্যক্রম চালু করবেন।
তিনি জানিয়েছেন, ঢাকায় পানীয়জলের সুব্যবস্থা করছেন এবং জনগুরুত্বপূর্ণ স্থানে একটি কুলিং স্পেস নির্মাণ করতে যাচ্ছেন, যেখানে পথচারীরা বিশ্রাম নিতে পারে। তিনি জানিয়েছেন ইতিমধ্যে বস্তি এলাকায় প্রচুর গাছ লাগিয়েছেন, যা এখন বস্তিবাসী যত্ন নিচ্ছে। গত বছর শহরের ১৫টি অনুন্নত এলাকায় পাঁচ হাজারের বেশি গাছ লাগিয়েছেন। পাশাপাশি স্থানীয় বাসিন্দাদের বোঝানোর চেষ্টা করছেন গরমের প্রকোপ থেকে নিজেকে এবং নিজের পরিবারকে কী কী উপায়ে রক্ষা করা যায়।
রাতারাতি পরিবর্তন সম্ভব নয় জানিয়ে কাজ করার ক্ষেত্রে সৃষ্ট অসুবিধাগুলোর কথাও উল্লেখ করেছেন বুশরা। প্রথমত সিটি করপোরেশনের বরাদ্দ পেলেও টেন্ডারের মাধ্যমে কাজ করতে অনেক সময় লাগে। আমলাতান্ত্রিক জটিলতার কথাও উল্লেখ করেছেন তিনি।
এই তো গেল বুশরা-বৃত্তান্ত। এখন খোঁজ করা যাক তীব্র তাপদাহে কারণ, প্রতিকার ও ভোগান্তি ছাপিয়ে কেন মূল আলোচনায় বুশরা?
এই রাজধানী ঢাকায় ২ কোটি মানুষের বাস। বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা এক শহর, যেখানে শিক্ষা, চিকিৎসাসহ যাবতীয় সব সুবিধা ঢাকাকেন্দ্রিক। এ দেশে কোনো সুযোগ কিংবা সুবিধার বিকেন্দ্রীকরণ করা হয়নি। রাজধানী ঢাকায়ও সব গড়ে উঠেছে অপরিকল্পিতভাবে। ফলে এই নগরে বিল্ডিংয়ের পর বিল্ডিং উঠেছে, হাইরাইজপাড়া হয়েছে, রাস্তায় প্রতিদিন গড়ে একশটি ব্যক্তি মালিকানাধীন গাড়ি নামছে, কোনায়-কানায়, গলি-ঘুপচিতে গড়ে উঠছে হাসপাতাল ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার, যেখানে-সেখানে শপিংমল, মার্কেট সোকল্ড ডেভেলপমেন্টের চূড়ান্ত। কিন্তু এর কোনো কিছুই পরিকল্পিত উপায়ে হয়নি। পৃথিবীর প্রায় বড় বড় সব নগরী তৈরি হয়েছে, পুনর্গঠন হয়েছে অত্যন্ত সুপরিকল্পিতভাবে। ঢাকা এক নগরী এখানে বসবাস রত মানুষ জানে না ঘরের ময়লা কোথায় ফেলবে, হাসপাতালের বর্জ্য কোথায় যায়, বৃষ্টির পানি কোথায় যাবে।
এর মধ্যে মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘায়ের মতো রয়েছে নাগরিকদের অসচেতন ও নাগরিক আচরণ। শিক্ষিত থেকে অশিক্ষিত, ধনী থেকে গরিব খুব কম মানুষকেই পাওয়া যাবে যে বা যারা নাগরিক সচেতনতা রক্ষা করেন। কোল্ডড্রিংক খেয়ে রাস্তায় ক্যান কিংবা প্লাস্টিকের বোতল ছুড়ে মারার কোনো ধনী-গরিব নেই। গাড়ির গ্লাস খুলে কিংবা রিকশার প্যাডেল মারতে মারতে যে লোকগুলো রাস্তায় থুথু ছুড়ে দেয় তাদের অর্থনৈতিক শ্রেণিভেদ রুচি আর অভ্যাসে মোটেই পার্থক্য গড়ে তুলে দিতে পারেনি। ঢাকা শহরে প্রায় প্রতিটি রাস্তা বিস্কুটের প্যাকেট, চিপসের প্যাকেট, ডাবের খোসা, এমনকি ন্যাপকিনে স্তূপীকৃত। প্রতিটি নালা-নর্দমা বন্ধ।
যারা নিজের শহরকে এমন আবর্জনার ভাগাড় করে তোলে, তাদেরই দেখবেন দেশের বাইরে গেলে কী কঠোরভাবে নাগরিক নিয়ম আর ট্রাফিক রুল মেনে চলে।
তো এই শহরের তাপপ্রবাহ যখন অতীতের সব রেকর্ড ভাঙতে বসেছে তখন হাতের কাছে পাওয়া গেছে হিট অফিসারকে। গরম কেন? তিনি কী করছেন? তিনি কী করেছেন গত এক বছরে?
অবস্থাদৃষ্টে বোধ হচ্ছে বুশরা আফরিন কোনো সোনার কাঠি নিয়ে চিফ হিট অফিসারের দায়িত্ব নিয়েছেন। যা কিনা জাদুমন্ত্র বলে রাতারাতি রাজধানী ঢাকাকে আমূল পালটে দিতে পারে। বুশরাকে এই আক্রমণ ট্রল করার যথার্থ কারণ রয়েছে।
প্রথমত তিনি নারী। নারী সে যেকোনো পজিশন ধারণ করুক না কেন তাকে মানুষ যা খুশি তা বলার অধিকার সংরক্ষণ করে। তার ওপর তিনি সুন্দরী। তাকে দু-চার কথা না বললে চলে? তিনি মেয়রের কন্যা। অতএব দেশে কেন এত গরম, সব দোষ নন্দ ঘোষ চিফ হিট অফিসার বুশরা আফরিনের।
বুশরা ইতিমধ্যে যে উদ্যোগগুলো নিয়েছেন, সব কয়টি বেশ অভিনব। তিনি রাতারাতি পালটে ফেলতে পারবেন না কিন্তু উদ্যোগ নিচ্ছেন হয়তো তার সুফলও আসবে। তার আগে আমাদেরও কি উচিত নয় নিজেদের দায় এবং দায়িত্ব নিয়ে ভাবা?
খোদ ঢাকা শহরের কথা বাদই দিলাম। মফস্বল খ্যাত ঢাকার বাইরের শহরগুলো পর্যন্ত বসবাসের অনুপযোগী করে তুলেছে। বিনা কারণে গাছপালা কেটে সাফ করা হয়েছে, পুকুর-নালা ভরাট করা হয়েছে। যার ফলশ্রুতিতে দেশের জলবায়ু এমন চরম ভাবাপন্ন হয়ে উঠেছে। আর আমরা উদোর পিণ্ডি বুধোর ঘাড়ে চাপানোর মতো করে কেবল বলে যাচ্ছি ‘চিফ হিট অফিসার’ কী করছেন।
আমি জানি না আসলে তিনি কী করতে পারতেন, কী করবেন ভবিষ্যতে। আমরা দৃশ্যমান কিছু কাজ দেখতে পাচ্ছি, তিনি উদ্যোগ নিয়েছেন, নিচ্ছেন। পরিকল্পনার কথা বলছেন।
আমরা এও জানি না এসব পরিকল্পনা পদক্ষেপ আদৌ কোনো কাজে আসবে কিনা। এই পদক্ষেপগুলো গবেষণালব্ধ এবং পরিকল্পিত কিনা। আমাদের আদতে জানা দরকার এই যে পরিকল্পনা ঢাকা সিটি করপোরেশনের উত্তরের জন্য নেওয়া হয়েছে তা সারা দেশে নেওয়া হবে কিনা। এসব পদক্ষেপে দেশের জলবায়ু আর আবহাওয়ার সামান্যতম পরিবর্তন ঘটবে কিনা।
সর্বোপরি রাষ্ট্রীয় পদক্ষেপের ঊর্ধ্বে মানুষের সচেতনতা, ক্ষমতাবানদের দুর্বৃত্তায়ন, ক্ষমতা কিংবা অর্থের দাপটে প্রকৃতিকে যথেচ্ছ হত্যা, উন্নয়নের মহাযজ্ঞের নামে নদীমাতৃক ভূপ্রকৃতিকে বিরানভূমি বানানোর বিপরীতে দৃঢ় অবস্থান না নিলে বুশরা বুশরা, হিট অফিসার অফিসার মাতমই সার হবে। কাজের কাজ কিছু হবে না। সে আমরা সচেতনভাবেই বুশরা নামের নারীকে আক্রমণ করি কিংবা অসচেতনভাবে জোয়ারে গা ভাসিয়েই করি। আমাদের মূলত প্রয়োজন এই চরম ভাবাপন্ন আবহাওয়া থেকে মুক্তি।
সাহিত্যিক ও কলাম লেখক
সময়ের আলো/আরএস/