ই-পেপার মঙ্গলবার ২২ অক্টোবর ২০২৪
মঙ্গলবার ২২ অক্টোবর ২০২৪

ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ : মোশতাক ও জিয়ার পাশবিক চরিত্রের নগ্ন প্রকাশ
প্রকাশ: বৃহস্পতিবার, ২৬ সেপ্টেম্বর, ২০১৯, ১২:০০ এএম  (ভিজিট : ৪৮৮)
পৈশাচিক মানুষ, নৃশংস সরকার এবং পশুসত্তার পক্ষেই শুধু কোনো মানব দেশে এমন বর্বর কালো আইন বা অধ্যাদেশ প্রবর্তন করা সম্ভব। অবশ্য যারা করেছে তাদের স্বভাবকে পাশবিকতার সঙ্গেই তুলনা করা যায়। একজন বাংলার নতুন মীরজাফর আর একজন মোনাফেক। পরিকল্পিতভাবে জাতির পিতাকে খুন করিয়ে সেসব খুনিদের সব বিচারের ঊর্ধ্বে রেখে সাধারণ জীবনযাপনের আইনগত ব্যবস্থা করা কোনো সামান্য মানবিক গুণসম্পন্ন মানুষের পক্ষে যে কোনোভাবেই সম্ভব নয় তা এক স্বরে সবাই স্বীকার করবে। আমরা যারা বয়সে বড় তারা সবাই দেখেছি, নীরবে কেঁদেছি, বাকরুদ্ধ থেকেছি কারণ আইনকে অবরুদ্ধ করে রেখেছিল অমানুষেরা। কথা বললেই খুন আর সে খুন সম্পর্কে এবং খুনির বিরুদ্ধে বিচার চাওয়া যাবে না।
সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যার অমোঘ নেতৃত্বে ৩০ লাখ প্রাণের আত্মত্যাগে এবং আড়াই লাখ মা-বোনের ইজ্জত-সম্ভ্রমের বিনিময়ে ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ বিশ^ মানচিত্রে উদ্ভব ঘটেছিল বাংলাদেশ নামের একটি স্বাধীন সার্বভৌম লাল-সবুজের বাংলাদেশ। ১৯৭২-৭৫ যুদ্ধবিধ্বস্ত, সমূহ ক্ষতিগ্রস্ত নতুন বাংলাদেশের বিনির্মাণ নিয়ে জাতির পিতা দেশে নানাবিধ উন্নয়ন কর্মকাÐ এবং বন্ধু দেশসমূহের সঙ্গে দেশের উন্নয়ন সাধনে প্রয়োজনীয় সহযোগিতা পাওয়ার প্রচেষ্টায় নিবেদিত। বন্ধু দেশসমূহে বঙ্গবন্ধু অভ‚তপূর্ব সমাদর এবং সহায়তার সাড়া পাচ্ছিলেন। কিন্তু অপরদিকে স্বাধীনতাবিরোধী দেশি এবং বিদেশি চক্র তাদের নীলনকশা শানিত করতে থাকে সিআইএর হেনরি কিসিঞ্জার এবং ঢাকা স্টেশন প্রধান ফিলিপ চেরী এবং বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক সহচর খোন্দকার মোশতাক আহমেদ (বিভিন্ন সূত্র মতে সেনা কর্মকর্তারা মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানের সঙ্গে গোপনে যোগাযোগ রেখে পরিকল্পনা চ‚ড়ান্ত করেছে)। তাই দেশ যখন দুরাবস্থা কাটিয়ে অগ্রগতির পথে সেই সময় কতিপয় মেজর পর্যায়ের সেনা কর্মকর্তা (খুনি ফারুক রহমান, শরিফুল হক ডালিম, মহিউদ্দিন আহমেদ, একেএম মহিউদ্দিন, বজলুল হুদা এবং নূর চৌধুরী নেতৃত্ব দিয়ে) পরিকল্পনা মাফিক মেজর হুদার নেতৃত্বে প্রথম আরমর্ড ডিভিশন এবং ৫৩৫তম ইনফেন্ট্রি ডিভিশনের বেঙ্গল লেন্সার সদস্য সমন্বয়ে গঠিত গ্রæপটি বঙ্গবন্ধুর ৩২নং বাসায় ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট সকাল ৫-৭টার মধ্যে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা, বঙ্গবন্ধুর তিন ছেলে শেখ কামাল, শেখ জামাল এবং ১০ বছরের শিশু শেখ রাসেল, ভাগ্নে শেখ ফজলুল হক মনি, বেগম আরজু মনি, সুলতানা কামাল, সেরনিয়াবাতসহ বঙ্গবন্ধু পরিবারের মোট ২০ জনকে খুন করে। অতঃপর বাংলার দ্বিতীয় মীরজাফর খোন্দকার মোশতাক প্রেসিডেন্ট হন এবং বাংলার মোনাফেক জিয়াউর রহমান সেনাপ্রধান হয়। শুধু হত্যাই নয়, খোন্দকার মোশতাক গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের গঠনতন্ত্রের আর্টিকেল ৯৩-এর ক্লজ (১) এ প্রদত্ত ক্ষমতাবলে (অর্ডারে এই রেফারেন্স উদ্ধৃত থাকলেও গঠনতন্ত্রের ওই আর্টিকেলে প্রেসিডেন্টকে তেমন কোনো ক্ষমতা দেওয়া ছিল না, এখানে মিথ্যার আশ্রয় নেওয়া হয়েছে যা চরম অপরাধ) সংসদ সেশন না থাকায় পরিস্থিতির প্রয়োজনে ঘটনার ৪২ দিন পর ২৬ সেপ্টেম্বর ১৯৭৫-এ খোন্দকার মোশতাক প্রেসিডেন্ট হিসেবে ইনডেমনিটি অর্ডিন্যান্স, ১৯৭৫ (ইনডেমনিটি অর্ডিন্যান্স নং-৫০, ১৯৭৫) জারি করার মাধ্যমে ১৫ আগস্টের সকালে একটি ঐতিহাসিক পরিবর্তন এবং সামরিক শাসন প্রবর্তনের জন্য গৃহীত পরিকল্পনা, পরিকল্পনার প্রস্তুতি বা বাস্তবায়ন বা তদসম্পর্কিত কোনোকিছু সম্পর্কে এবং সংশ্লিষ্ট কারও বিরুদ্ধে কোনো আইনগত ব্যবস্থা বা কার্যক্রম (প্রসিডিংস) গ্রহণ করা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করে। এভাবে ৩০ লাখ শহীদের রক্ত এবং আড়াই লাখ মা-বোনের ইজ্জত-সম্ভ্রমের বিনিময়ে বঙ্গন্ধুর নেতৃত্বে অর্জিত এই মহাপবিত্র ভ‚খÐে বিশ^নন্দিত সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের খুনি চক্রকে বিচারের কাঠগড়া থেকে রক্ষার উদ্দেশ্যে এই কালো অধ্যাদেশ জারি করে। এই অধ্যাদেশটি মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান ফরমাল স্ট্যাটুটে পরিবর্তন করে এর পরিধি বাড়িয়ে ১৫ এপ্রিল, ১৯৭৯-এর মধ্যে সংঘটিত সব মিলিটারি ক্যুজ, মার্শাল ল’ ডিক্রিজ ও অর্ডারজ, অন্যান্য রাজনৈতিক ঘটনা এবং ডিক্রিজ এ আইনের অন্তর্ভুক্ত করে। মেজর জেনারেল জিয়া ৯ জুলাই, ১৯৭৯ সালে সংসদের মাধ্যমে এটাকে আইন (অ্যাক্ট) হিসেবে পাস করে পঞ্চম সংশোধনী হিসেবে সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করে। তার এ কর্মটি ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্টের ঘটনার সঙ্গে তার সম্পৃক্ততার ইঙ্গিত প্রমাণ করে এবং বাংলাদেশের পবিত্র সংবিধানকে কলুষিত করে। এই ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ এবং ইনডেমনিটি অ্যাক্টের বলে ১৯৭৫ সালের সকালের খুনের সঙ্গে যেকোনোভাবে সংশ্লিষ্ট সবাই বিচার বহিভর্‚ত থেকে যায় এবং তারা দেশে এবং বিদেশে সরকারি বিভিন্ন উচ্চপদে দায়িত্ব পালন করে, সরকারি গাড়িতে বাংলাদেশের পবিত্র পতাকা উড়ায়ে দাপটের সঙ্গে ঘুরে বেড়ায়। ডালিম বেইজিং, হংকং এবং ত্রিপোলি এবং সর্বশেষ কেনিয়ায় বাংলাদেশের হাইকমিশনার হিসেবে দায়িত্ব পালন করে। আজিজ পাশা রোম, নাইরোবি এবং হারারেতে বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করে। মোনাফেক জিয়াউর রহমান আল্লাহ প্রদত্ত বিচারে অপহত্যার বদলে অপহত্যা হিসেবে সেনাদের হাতে শুধু নিহত নয়, নিশ্চিহ্ন হয়ে যায় চট্টগ্রাম সার্কিট হাউসে। পরবর্তীতে প্রেসিডেন্ট এরশাদও ওই আইনের সব সুযোগ-সুবিধা কাজে লাগায়।
বাংলাদেশের সৌভাগ্য, অনেক চড়াই উৎরাই পার করে ১৯৯৬ সালে বঙ্গবন্ধুকন্যা ইস্পাত-কঠিন বিশ^নেত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা ক্ষমতায় এসেই নির্বাচিত সংসদের রায়ে পঞ্চম সংশোধনী বাতিল করে সংবিধান থেকে ওই কালো ইনডেমনিটি আইন মুছে দেন, সংবিধানের পবিত্রতা ফিরিয়ে আনেন এবং তারপর থেকেই আইন মোতাবেক খুনিদের বিচারকার্য শুরু করেন। কালো ইনডেমনিটি অর্ডিন্যান্স এবং আইন দ্বারা খোন্দকার মোশতাক এবং প্রেসিডেন্ট জিয়া যেসব খুনিকে বিচারের ঊর্ধ্বে রেখে তাদের হাতে বাংলাদেশের পবিত্র লাল-সবুজ পতাকা তুলে দিয়ে দেশ-বিদেশে বাংলাদেশের ভাবমূর্তিকে ধূলিসাৎ করার অপচেষ্টা করেছেন বঙ্গবন্ধুকন্যা বিশ^বরেণ্য জননেত্রী তাদের বিচারের আওতায় এনে, কয়েকজনের মৃত্যুদÐ কার্যকর করে দেশের ভাবমূর্তি পুনরুদ্ধার করেছেন। কয়েকজন প্রমাণিত বড় খুনি অন্য দেশে থাকায় তাদের রায় কার্যকর করা যাচ্ছে না। সংশ্লিষ্ট দেশসমূহের প্রতি দেশবাসীর আবেদন অপরাধীকে দেশে ফেরত দিন, আপনারা পাপমুক্ত হন এবং আমাদের দেশের ওইসব খুনির ক্ষেত্রে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় সহায়তা করুন।

অধ্যাপক ও সাবেক উপাচার্য, বঙ্গবন্ধু শেখ
মুজিবুর রহমান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, গাজীপুর




সর্বশেষ সংবাদ

সর্বাধিক পঠিত


ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক : সৈয়দ শাহনেওয়াজ করিম, আমিন মোহাম্মদ মিডিয়া কমিউনিকেশন লিমিটেড এর পক্ষে প্রকাশক গাজী আহমেদ উল্লাহ। নাসির ট্রেড সেন্টার, ৮৯, বীর উত্তম সি আর দত্ত সড়ক (সোনারগাঁও রোড), বাংলামোটর, ঢাকা।
ফোন : +৮৮-০২-৯৬৩২৩৬৮-৭৪, ফ্যাক্স : +৮৮-০২-৯৬৩২৩৭৫ | ই-মেইল : shomoyeralo@gmail.com
close