ই-পেপার শুক্রবার ৩ মে ২০২৪
শুক্রবার ৩ মে ২০২৪

আলী যাকের এক নির্মল জ্যোতির নাম
প্রকাশ: শুক্রবার, ৪ ডিসেম্বর, ২০২০, ১১:১৯ পিএম আপডেট: ০৪.১২.২০২০ ১২:০৬ এএম  (ভিজিট : ৫৭২)
 তিনি বাংলাদেশ মঞ্চনাটক ও টেলিভিশন নাটকে সমান জনপ্রিয় অভিনেতা, নির্দেশক, নাট্যজন হিসেবে সবার কাছে সুপরিচিত হলেও আমরা জানি কি, আলী যাকের ছিলেন একজন নিয়মিত লেখকও? মঞ্চ, টেলিভিশন, চলচ্চিত্র, বিজ্ঞাপন আলী যাকেরকে খ্যাতির তিলক পরিয়ে দিলেও পেশাগত ব্যস্ততার আড়ালে তিনি একজন পুরোদস্তুর লেখক ছিলেন। লেখালেখি করতেন নিজের ভালোবাসা, আনন্দ ও একান্ত দায় থেকে।
আলী যাকেরের লেখালেখির শুরু বাল্যকাল থেকে। প্রথমে তিনি ছড়া লিখতেন। তারপর কবিতা। কবিতার পাশাপাখি গল্প লিখতেন। প্রবন্ধটা বিশেষ পছন্দ ছিল তার। আলী যাকেরের বাবা মুহাম্মদ তাহের সরকারি উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা ছিলেন বলে আজ এই শহরে তো কাল ওই শহরে বদলির কারণে পরিবারের সাথে তাকেও ছুটতে হয়েছে এক স্থান থেকে আরেক স্থানে। শহর থেকে শহরে ঘুরে বেড়ানো, নতুন নতুন মানুষের সাথে পরিচয়, নতুন জায়গা চেনা, জানা তাকে লেখার খোরাক দিত। তা দিয়ে তিনি লিখতেন। মানুষ তার অভিজ্ঞতার চেয়ে জ্ঞানী নয়। আলী যাকের চারপাশকে তুলে ধরতেন গল্পে, কবিতায়, ছড়ায়। পিতার সাথে ঘুরতে ঘুরতে তারা যখন বর্তমান পুরান ঢাকার গেÐারিয়ায় নিজেদের নামে একটা বাড়িতে তখন ওই বয়সে পাড়ার সাহিত্য ও সংস্কৃতিমনা সঙ্গীদের সাথে নিয়ে তিনি সম্পাদনা ও প্রকাশ করতেন ‘কিশলয়’ নামে দেওয়াল পত্রিকা। এবং সেই দেওয়াল পত্রিকাটি সচল রাখতে গিয়ে দুই হাতে লিখতেন। আরও পরে যখন সচেতন যুবক, লেখাগুলো একসাথে দেখার স্বপ্ন জাগল, তখন তিনি দেখলেন কোনো লেখাই তার সংগ্রহে নেই।
আবার যখন শুরু করলেন তখন আর কবিতায় ফিরলেন না আলী যাকের, গল্পে ফিরলেন না, ছড়ায়ও না। প্রবন্ধ, মুক্তগদ্য, স্মৃতিকথা, ভ্রমণ কাহিনি লিখতে থাকলেন। তিনি তার প্রথম গ্রন্থ ‘সেই অরুণোদয় থেকে’-এর প্রচ্ছদ কথায় বলেছেন, ‘(সেই অরুণোদয় থেকে) আমার জীবনের একটি অংশের স্মৃতি। লিখতে লিখতে এত যে দীর্ঘ হয়ে যাবে, ভাবিনি। প্রথম বাংলা একাডেমীর জার্নাল ‘উত্তরাধিকার’-এ শুরু। তারপর লিখছিলাম সাপ্তাহিক ২০০০-এ।
আমার বন্ধু-বান্ধবরা সবাই বলল, যেটুকু লিখেছি, তা-ই দিয়ে একটা বই হয়ে যেতে পারে। অতএব, এই হলো সেই ‘অরুণোদয় থেকে’-এর জন্ম রহস্য। এই গোটা লেখাটিতেই আমার অভিজ্ঞতাগুলো চলমান ছবির মতো একটি থেকে আরেকটিতে রূপান্তরিত হয়েছে। কোথাও রং চাপানোর চেষ্টা করিনি। যেমন দেখেছি, তেমন লিখেছি। মাঝে মাঝে দেখাকে ছাড়িয়ে বোধ-এর বর্ণনা স্থান পেয়েছে এই গ্রন্থে।’ এই সরল স্বীকারোক্তিই স্বীকার করে, আলী যাকের ছক কেটে লেখক হবার ইচ্ছায় পরিকল্পিতভাবে টেবিলে পৃষ্ঠা নিয়ে কোনো লেখা তৈরি করতে ইচ্ছুক ছিলেন না। প্রকৃত লেখক যেমন তার ভালোলাগার প্রকাশ ঘটায় মাত্র, দায় কিংবা দায়িত্বের কিংবা একটা জীবন টুকে রেখে যাওয়ার ইচ্ছায়; আলী যাকের তার ব্যতিক্রম নয়। নিজের দেখাকে, নিজের অভিজ্ঞতাকে, নিজের উপলব্ধিকে কাগজে লিপিবদ্ধ করেছেন, মলাটের ভাঁজে তুলে দিয়েছেন। তিনি একের পর এক লিখে গেছেন সামাজিক,
সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক, সমসাময়িক নানাবিধ বিষয়।
প্রখ্যাত লেখক, সম্পাদক আবুল হাসনাত আলী যাকেরের প্রবন্ধ বিষয়ক ‘নির্মল জ্যোতির জয়’ বইয়ের ফ্ল্যাপে লিখেছেন, “বাংলাদেশ মঞ্চ ও টিভিনাটকের বিশিষ্ট এ ব্যক্তিত্ব সংবাদ-এর শিল্প ও সংস্কৃতি পাতায় ‘নির্মল জ্যোতির জয়’ শিরোনামে দীর্ঘদিন কলাম লিখেছেন। শিল্প, সংস্কৃতি ও সমাজ অবলোকনে তার ভিন্ন দৃষ্টি আমাদের তৃতীয় নয়নকে খুলে দিয়েছে। তার শিল্পিত মনন কখনো বাংলাদেশের বিপন্ন সংস্কৃতি চর্চাকে সম্ভাবনার আলোকে প্রত্যক্ষ করেছে।
কখনো সমাজের অসঙ্গতিকে দেখিয়ে দিয়েছে। মঞ্চনাটকের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতাকেও তিনি স্পর্শ করে গেছেন কখনো। এ অভিজ্ঞতা নাটক, চলচ্চিত্র ও শিল্পের পরিমÐলে অভিঘাত সৃষ্টির ক্ষেত্রে সহায়ক হয়েছে। ‘নির্মল জ্যোাতির জয়’ বাংলাদেশের বৃহত্তর পাঠক সমাজে নন্দিত হবে।” আলী যাকের তার ব্যক্তিগত সুখ্যাতিকে সামনে উজিয়ে ধরে অন্য অনেকের মতো সাময়িক লেখক বনে যাওয়ার নিন্দিত চেষ্টায় নিজেকে শামিল করেননি। ব্যক্তি আলী যাকেরের যে দৃষ্টি, যে দেখা, যে অভিজ্ঞতা, যে বোধ, যে দায়, যে দায়িত্ব তা তিনি নির্ভয়া বোধে লিখতে চেষ্টা করেছেন, লিখেছেন। লিখতে যেয়ে অনেকের অনেক রকম কথা তিনি শুনেছেন; সেসব পাশে রেখে লেখাকে এগিয়ে নিয়েছেন। একটা জীবনের অর্জন বা অভিজ্ঞান পরের প্রজন্মের জন্য রেখে যাবেন বলে পরিশ্রম করেছেন। রেখে গেছেন। তার সর্বশেষ বই ‘মধ্যাহ্ন, অপরাহ্ণ!’-এর ভ‚মিকা অংশে অনেক কথার সাথে তিনি স্পষ্টতই বলেছেন কী তিনি লিখছেন, কেন বা কীভাবে লিখছেন, ‘নতুন কিছু বলার সাধ্য আমার নেই, অত বড়মাপের চিন্তক কিংবা লেখক আমি নই। আসলে বলছি কেন এসব কথা? বলছি এই কারণে যে, জীবনটা তো আমার। তাই জীবনটাকে যেমন দেখেছি আমি তেমনি তো লিখবো। কিন্তু আমার সুহৃদরা চাইবে এইটা একটু বেশি করে লিখি, ওইটা একটু কম। এটা সবসময় সম্ভব হয়ে ওঠে না। আসল সত্য এই যে, সবাইকে সব সময় খুশি করা যায় না। আমি জানি, আমি যা ভাবছি তা সত্য নাও হতে পারে তবুও যা ভাবছি তা তো আমারই ভাবনা। সে কারণে আমাকে ওইভাবেই বলতে হবে।’
ওইভাবেই তিনি তার সবকয়টি লেখায়, সবকয়টি গ্রন্থে বলেছেন নির্ঝরভাবে। সত্যনিষ্ঠ অবলোকনে। সরলভাবে। অনেকে ভাবতেই পারে, একজন বিজ্ঞাপন নির্মাতা, একজন নির্দেশক, একজন অভিনেতা, একজন মঞ্চের লোক বই লিখলে কী-ই বা লিখবে! প্রতিদিনের নোটখাতা! এই তো? কিন্তু না। আলী যাকেরের প্রতিটি লেখা সে কথা বলে না। বলে একজন বিচক্ষণ লেখকের কথা। সুশীল, শানিত, উপযুক্ত শব্দ আর বাক্যের যোগ বলে চ্যুতি-বিচ্যুতির নানা প্রাসঙ্গিকতার কথা। বলে নানান বৈচিত্র্যভঙ্গিতে দেখা বিপুলা পৃথিবীর সমাজ ও সংস্কৃতির কথা। লেখার বর্ণনায় সত্যি এক লেখকের লেখা পাঠের তৃপ্তি মেলে প্রতি পর্বের বর্ণনায়।
আলী যাকেরের লেখা সহজ, ঝরঝরা। নানান আঙ্গিকে, নানান প্রসঙ্গ নিয়ে মেদহীন রচনা। অধিকাংশে সাহিত্য রসযুক্ত। ‘নির্মল জ্যোতির জয়’ গ্রন্থের ভ‚মিকা থেকে আমরা পাই, আলী যাকের নিজেই স্বীকার করেছেন তার লেখায় গভীর তত্ত¡কথা নেই, আছে নিত্য দৃষ্ট ঘটনার উদ্ভ‚ত প্রতিক্রিয়া। এই গ্রন্থেই তার সাক্ষ্য মেলে; এক প্রবন্ধে তিনি লিখছেন, ‘বেশ কিছুদিন আগে গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত আমাদের ক্ষতাসীন দলের একজন কপ্প সমর্থক-এর সঙ্গে খোলামেলা আলাপ হচ্ছিলো। সব ধরনের লোকের সঙ্গেই একেবারে খোলামেলা আলাপ করতে আমি সবসময়ই আগ্রহী।
আমি মনে করি এতে করে মানুষের মেধা উপকৃত হয়। মানুষ অর্জন করে। তার হারাবার কোনো ভয় থাকে না। বিশেষ করে, কতগুলো পরীক্ষিত, প্রতিষ্ঠিত সত্য সম্বেন্ধে কোনো ব্যক্তি বা কোনো দলের যদি ভিন্ন ধারণা থাকে তবে খোলামেলা আলোচনার মাধ্যমে তা শোধরানোর চেষ্টা করা যেতে পারে। যদিও বেশিরভাগ সময়েই এই প্রচেষ্টা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। তবু চেষ্টা করতে দোষ কী? আর কিছু না হোক এই ধরনের আলোচনার মাধ্যমে জানা তো যায় যে প্রচলিত, প্রতিষ্ঠিত যেসব মত বা মূল্যবোধ আছে তার বিরুদ্ধে কি যুক্তি ভিন্নমতাবলম্বীরা দাঁড় করিয়েছেন।’
আলী যাকের বিদেশি নাটক থেকে অনুবাদ করেছেন, গল্পকে নাট্যরূপ দিয়েছেন, সাজিয়েছেন চিত্রনাট্য। তিনি নাটক লিখেছেন। দৈনিক প্রথম আলোতে ‘আলোকের এই ঝর্ণাধারায় (০৬)’, দৈনিক কালের কণ্ঠে ‘আলোকের এই ঝর্ণাধারায় (০১)’, দৈনিক সমকালে ‘হৃদয়নন্দন বনে’ এবং ‘ধর নির্ভয় গান’ ধারাবাহিকে বিভিন্ন শিরোনামে এবং দৈনিক সংবাদ ও জনকণ্ঠসহ বিভিন্ন দৈনিকে নিয়মিত লিখেছেন সমসাময়িক এবং দেখা-অদেখার নানান বিষয় নিয়ে। রচনা করেছেন সেই অরুণোদয় থেকে (স্মৃতিগ্রন্থ), দূরে কাছে স্বর্গ আছে (নানাদেশ ও ভ্রমণ), ধর নির্ভয়া গান (বিবিধ বিষয়ক প্রবন্ধ), নির্মল জ্যোতির জয় (সমসাময়িক বিষয়প্রতিক্রিয়া), মধ্যাহ্ন, অপরাহ্ণ! (আত্মজৈবনিক)সহ আরও কিছু গ্রন্থ।
মঞ্চের এই মহীরুহ অভিনয় করেছেন ব্রেশটের ‘পুন্টিলা অ্যান্ড হিজ ম্যান মাট্টি’ অবলম্বনে গ্যালিলিও এবং দেওয়ান গাজীর কিস্সা, শেক্সপিয়রের টেমপেস্ট এবং ম্যাকবেথ ইত্যাদি বিখ্যাত নাটকে। অভিনয় ও নির্দেশনা দিয়েছেন অচলায়তন, সৎ মানুষের খোঁজে, তৈল সংকট, সৈয়দ শামসুল হকের নূরলদীনের সারা জীবনসহ বেশ কিছু নাটক। এদেশীয় আধুনিক বিজ্ঞাপন শিল্পের একজন পথিকৃৎ তিনি। তিনি করাচি রেডিওতে বাংলা সংবাদ পাঠ করেছেন, পরে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে ইংরেজি বিভাগের অনুষ্ঠান প্রযোজক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন।
কাজ করেছেন ঘোষক হিসেবে। ক্রিকেটে ধারাভাষ্যকারের কাজও তিনি করেছেন পেশাদারিত্বের সাথে। ছিলেন শব্দসৈনিক। বাংলাদেশ টেলিভিশনে ধারাবাহিক বহুব্রীহি, আজ রবিবার কিংবা একক নাটক একদিন হঠাৎ, নীতু তোমাকে ভালোবাসি, পাথর সময়, পাÐুলিপি ইত্যাদি তার উল্লেখযোগ্য কাজ। আগামী, নদীর নাম মধুমতী, লালসালু, রাবেয়া চলচ্চিত্রেও রয়েছে তার উজ্জ্বল পদচারণা।

ষ কবি ও প্রাবন্ধিক






সর্বশেষ সংবাদ

সর্বাধিক পঠিত


ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: কমলেশ রায়, আমিন মোহাম্মদ মিডিয়া কমিউনিকেশন লিমিটেড এর পক্ষে প্রকাশক গাজী আহমেদ উল্লাহ
নাসির ট্রেড সেন্টার, ৮৯, বীর উত্তম সি আর দত্ত সড়ক (সোনারগাঁও রোড), বাংলামোটর, ঢাকা।

ফোন : +৮৮-০২-৯৬৩২৩৬৮-৭৪, ফ্যাক্স : +৮৮-০২-৯৬৩২৩৭৫ | ই-মেইল : shomoyeralo@gmail.com
close