ই-পেপার শুক্রবার ৩ মে ২০২৪
শুক্রবার ৩ মে ২০২৪

কবিতা, বিচিত্রময়ী
প্রকাশ: শুক্রবার, ১১ ডিসেম্বর, ২০২০, ১০:২২ পিএম  (ভিজিট : ৪৬৩)
 পথে ঘাটে অনেকের কথা শুনেই মনে হতে পারে তার মাঝে কেমন একটা কবিত্ব ভাব আছে। এখনও কিছু কিছু লোক দেখা যায়, যারা অন্ত্যমিল দিয়ে কথা বলে। কিন্তু জীবনানন্দ দাশের বরাত দিয়ে বলা যায়, ‘সকলেই কবি নয়, কেউ কেউ কবি।’ এখন যদি প্রশ্ন করা হয়, কবি কে? এই সরল প্রশ্নের উত্তর হবে, যিনি কবিতা লেখেন তিনিই কবি। কিন্তু তারপর যদি প্রশ্ন করা হয়, কবিতা কী? না, এই প্রশ্নের মীমাংসা করা এত সহজ নয়। এই নিয়ে আছে বিস্তর তর্ক, বিতর্ক, মতবাদ। তবে আমাদের মনে হয়, এর একটি সহজ উত্তর কবি জীবননান্দ দাশ দিয়ে গেছেন। বলেছেন, ‘কবিতা অনেক রকম।’ সত্যিই তাই। হাজার বছরের বাংলা কবিতার দিকে তাকালে দেখি, কত বিচিত্র ধরনের কবিতায় সমৃদ্ধ হয়ে আছে বাংলা কবিতা।
কবিতার কত ধারা এলো, গেল কিন্তু কবিতা আজও আছে। থাকবে। যতদিন মানুষের অনুভ‚তি থাকবে, ততদিন কবিতা থাকবে। সঞ্চারিত হবে মানুষের মন থেকে মনে, বোধ থেকে বোধে, অনুভবে। সেই কবে বৌদ্ধ সহজিয়ারা নিজেদের গুপ্ত সাধনতত্ত¡কে সংগীতে বেঁধেছিলেন। তাদের সেই সাধন-সংগীতেও উঠে এসেছিল প্রকৃতির বর্ণনা, শ্রেণিচেতনা, প্রেম। তারা কি তখন বুঝতে পেরেছিল, বাংলা ভাষার আদি নিদর্শন হবে তাদের কবিতা? প্রাচীন বাংলা সাহিত্য বলতে তাদের গানগুলোকেই বুঝব? তারপর পেলাম ‘শ্রীকৃষ্ণ কীর্তন’, ‘বৈষ্ণব পদাবলি’, ‘মঙ্গলকাব্য’। এই মঙ্গলকাব্যেরই কত ধারা! চÐীমঙ্গল, মনসামঙ্গল, ধর্মমঙ্গল, কালিকামঙ্গল, আরও কত কী! পেলাম রোমান্টিক প্রণয়োপাখ্যান, মৈমনসিংহ গীতিকা, অনুবাদ সাহিত্য, কবিগান প্রভৃতি। আধুনিক যুগে এসে কবিতার এই প্রবাহের সঙ্গে যুক্ত হলো মহাকাব্য, সনেট, গীতিকবিতা প্রভৃতি। মাত্র কয়েক লাইনে বলা হয়ে গেল, অথচ শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে রচিত এই সাহিত্য, কবিতা। কত শত কবি সুখে-দুঃখে তাদের জীবন পোড়ানো আগুনে জ¦ালিয়েছে সাহিত্যের দীপ, তাদের সবার নামও আজ নেই। মুছে গেছে কালের জলে। এমনই হয়।

২.
কবিতা কেমন হবেÑ তা কখনই সংজ্ঞা দিয়ে নির্ণয় করা সম্ভব নয়। বলা যাবে না, এই এই বৈশিষ্ট্য থাকলেই উৎকৃষ্ট হবে। এটি অসম্ভব। বলে কয়ে কখনও কবিতায় প্রাণ প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব নয়। শিল্পের কোনো শাখাতেই তা সম্ভব নয়। উৎকৃষ্ট কবিতা হতে পারে কাজী নজরুল ইসলামের ‘বিদ্রোহী’ কবিতার মতো দীর্ঘ আবার হতে পারে হেলাল হাফিজের ‘অশ্লীল সভ্যতা’ কবিতার মতো দুই লাইনেরও। থাকতে পারে ছন্দের নিখুঁত গাঁথুনি আবার গদ্যছন্দের নিরেট দেওয়ালে রক্তজবা হয়ে হাসতে পারে কবিতা। হতে পারে অলঙ্কারে সজ্জিত, হতে পারে নিরলঙ্কার। কেউ কেউ বলেন, নতুন কিছু বলতে হবে। তা তো অবশ্যই। একই ছন্দ প্রকৃত কবিদের হাতে আলাদা হয়ে যায়। তারপরও বলতে হয়, নতুন কথা হলেই সেটা কবিতা হয় না। একটি উৎকৃষ্ট কবিতার সমস্ত বৈশিষ্ট্য ধারণ করলেই যে নতুন লেখাটি কবিতা হবে, সে গ্যারান্টি কেউ দিতে পারেনি, পারবে না।
কবিতা তখনই কবিতা হবে, যখন তাতে প্রাণ প্রতিষ্ঠা পাবে। এ প্রাণ প্রতিষ্ঠার জন্য কবির প্রয়োজন প্রস্তুতিকাল। নিরন্তর সাধনা। কবিকে কবিতার সব কলাকৌশল আয়ত্ত করতে হবে। জানতে হবে কবিতার ইতিহাস। নিষাদ যেমন পাখির গোত্র চেনে, কবিকেও তেমনি শব্দের নিষাদ হতে হবে। একজন কবি যখন শব্দকে ছত্রিশ ব্যঞ্জনায় বাজাতে পারবেন, তখনই তা হবে কবিতা। নইলে যত আয়োজনই হোক, সবই শব্দের শবে পরিণত হবে। কবিতা হবে না। অতীতের মহৎ কবিদের দিকে, কবিতার দিকে তাকালেই উপর্যুক্ত কথার সত্যতা পাওয়া যাবে।
তবে দুঃখের বিষয়, বর্তমানে কোনো ধরনের প্রস্তুতি না নিয়েও অনেকেই কবিতা লিখতে চলে আসে। অলঙ্কার শাস্ত্র সম্পর্কে ন্যূনতম জ্ঞান তাদের মাঝে নেই। অন্ত্যমিলকে তাদের অনেকে ছন্দ বলে বসে থাকে। একদল নিজেদের অক্ষমতা ঢাকতে জোরগলায় বলে বেড়ায়, আধুনিক কবিতায় ছন্দের কী প্রয়োজন? ছন্দ বক্তব্যকে হালকা করে। ‘এটা সেটা আরও কত কী।’ কবিতা প্রকাশ এখন সহজলভ্য হয়ে যাবার কারণে সর্বত্রই তাদের কোলাহল পরিলক্ষিত হয়। বইমেলায়ও নতুন মোড়কে এসে উপস্থিত হয় তাদের কাব্য। কবিতার সংকলন জুড়ে তাদের ভিড়। যদিও এসব নিয়ে চিন্তার কিছু নেই। এই সব কোলাহল কালের করাল গ্রাসে আপনাআপনিই চাপা পড়ে যাবে। পক্ষান্তরে প্রকৃত কবিতা সবসময়ই উজ্জ্বল। তার জন্য কোনো কোলাহলের প্রয়োজন হয় না। সে নিজগুণেই পৌঁছে যায় সংবেদনশীল পাঠকের হৃদয়ে। এমনও হয়েছে শত শত বছর আড়ালে থাকারও পরও প্রকৃত কবিতা তার মর্যাদা ঠিকই আদায় করে নিয়েছে।

৩.
কবিতার সংকলের কথা যখন চলেই এলো, এ নিয়ে দুটো কথা বলা যায়। কবিতার সংকলনের গুরুত্ব অত্যধিক। মনে রাখতে হবে, আমাদের আদি সাহিত্যের নিদর্শন ‘চর্যাপদ’ কবিতার বলা ভালো গানের সংকলন। এটি কোনো এক কবির কাব্য নয়। এক্ষেত্রে ‘বৈষ্ণব পদাবলি’, ‘মৈমনসিংহ গীতিকা’র কথাও উল্লেখ করা যেতে পারে। তবে সংকলনের সীমাবদ্ধতা যে নেই, তা নয়। একজন সম্পাদকের নিষ্ঠা, অভিরুচি, গ্রহণ-বর্জনের ক্ষমতার ওপর নির্ভর করে সংকলের সাফল্য-ব্যর্থতা। আমরা দেখতে পাই আধুনিক কবিতার কোনো সংকলনই সমালোচকদের দৃষ্টিতে ত্রæটিমুক্ত নয়। ‘বাংলা কাব্য-পরিচয়’ নামক একটি সংকলন ১৯৩৮ সালে প্রকাশিত হয় বিশ^ভারতী থেকে। এর সম্পাদক ছিলেন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। এর সমালোচনায় মুখর হয়ে উঠলেন বুদ্ধদেব বসু। এর বিরুদ্ধে রিভিয়্যু লিখলেন কবিতা পত্রিকায়। বিশ^ভারতী পরবর্তী সময় সেই বই প্রত্যাহার করে নেয়। পাশাপাশি কবিতা পত্রিকা থেকে বাদ পড়ে বিশ^ভারতীর বিজ্ঞাপন। সেটি অন্য প্রসঙ্গ। এরপর কবিতা ভবন থেকে আবু সয়ীদ আইয়ুব ও হীরেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়ের সম্পাদনায় ‘আধুনিক বাংলা কবিতা’ প্রকাশিত হলো।
অর্থাৎ বুদ্ধদেব বসুই সেটি প্রকাশ করালেন। না, এবারও বুদ্ধদেব বসুর মন ভরল না। এবার বুদ্ধদেব বসু নিজেই ‘আধুনিক বাংলা কবিতা’ নামে আরেকটি সংকলন প্রকাশ করেন। কিন্তু এটিও সমালোচকদের মন ভরাতে পারিনি। এই তিনটি সংকলনই প্রশ্নের সম্মুখীন হয়েছিল কবি বাছাইয়ের ক্ষেত্রে উদার ছিল বলে। ১৯৯৪ সালে বাংলাদেশ থেকে ‘আধুনিক বাংলা কবিতা’ নামক একটি সংকলন প্রকাশিত হয় হুমায়ুন আজাদের সম্পাদনায়Ñ এটি বিতর্কিত হয় কবিতা বর্জনের কারণে। তিনি তার সংকলন থেকে বাদ দেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে। বাদ পড়েন কাজী নজরুল ইসলাম, জসীমউদ্দীনসহ অনেকেই। তিনি সংকলন শুরু করেন জীবনানন্দ দাশের কবিতা দিয়ে অর্থাৎ ত্রিশের কবিতা দিয়ে। শেষ করেন ষাটের কবিদের কবিতা দিয়ে। মনে রাখতে হবে সংকলনটি যখন তিনি প্রকাশ করেন, তখন সত্তরের দশকের কবিদের কবিতা চর্চার কাল দুই দশক হয়ে গেছে। অর্থাৎ তিনি অগ্রজীয় উন্নাসিকতায় সত্তরকে খারিজ করে দিয়েছেন। তিনি সংকলন থেকে বাদ দিয়েছেন সৈয়দ আলী আহসান, আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ, আল মাহমুদ, ফজল শাহাবুদ্দীন ও আবদুল মান্নান সৈয়দকে। বাদ দেওয়ার একটি ব্যাখ্যাও তিনি দিয়েছেন। আমরা জানি বাংলা কবিতার ইতিহাস রচনা করতে গেলে এ নামগুলো এসে হাজির হবে। তা ছাড়া কবিদের ব্যক্তিগত জীবনের চেয়ে, ব্যক্তিগত বিশ^াসের চেয়ে তাদের কবিতা কী বলে সেই বিষয়টিই মুখ্য। হুমায়ুন আজাদও যে তেমনটি বিশ^াস করতেন না, তা নয়। যেমন ড. হুমায়ুন আজাদ ধর্মবিশ^াসের কারণে এলিয়টকে বিভ্রান্ত বলেছেন কিন্তু মহাকবি বলে স্বীকারও করে নিয়েছেন। তিনি লিখেছেন, ‘বিজ্ঞান এভাবে আলোড়িত করতে পারে না, কেননা তা অব্যর্থ; ধর্ম পারে না, কেননা তা অসুন্দর। পারে কবিতা, পেরেছিলেন এলিয়ট; বিশ শতকের মহাকবি, বিভ্রান্ত, কিন্তু সুন্দর।’
তবে বাংলা কবিতায় তিনি কবিদের জীবন থেকে কেন কবিতাকে আলাদা করতে পারেননি, শুধু কবিতার সৌন্দর্যে বিমোহিত হতে পারেননি, সেই প্রশ্নের উত্তর আজ আর পাওয়া যাবে না।
এত আলোচনা-সমালোচনার পরেও বলা যায়, কবিতা সংকলনের গুরুত্ব অনস্বীকার্য। হয়তো হাজার বছর পরে এখনকার বাংলা কবিতার সন্ধান, গতি-প্রকৃতি কোনো সংকলন থেকেই উদঘাটিত হবে, যেমন হয়েছিল ‘চর্যাপদে’র মাধ্যমে। আবার তা নাও হতে পারে। কেননা কবিতা বড়ই রহস্যময়ী। কখন সে কার কাছে ধরা দেবে, কার কাছ থেকে চলে যাবে, কোন রূপে প্রকাশিত হবেÑ কেউ জানে না।

কবি ও প্রাবন্ধিক





সর্বশেষ সংবাদ

সর্বাধিক পঠিত


ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: কমলেশ রায়, আমিন মোহাম্মদ মিডিয়া কমিউনিকেশন লিমিটেড এর পক্ষে প্রকাশক গাজী আহমেদ উল্লাহ
নাসির ট্রেড সেন্টার, ৮৯, বীর উত্তম সি আর দত্ত সড়ক (সোনারগাঁও রোড), বাংলামোটর, ঢাকা।

ফোন : +৮৮-০২-৯৬৩২৩৬৮-৭৪, ফ্যাক্স : +৮৮-০২-৯৬৩২৩৭৫ | ই-মেইল : shomoyeralo@gmail.com
close