ই-পেপার বৃহস্পতিবার ২ মে ২০২৪
বৃহস্পতিবার ২ মে ২০২৪

প্রকৃতিপ্রেমিক  কবির হৃদয়  সংবেদ : বৃক্ষমঙ্গল
প্রকাশ: শুক্রবার, ৪ ডিসেম্বর, ২০২০, ১১:১৯ পিএম আপডেট: ০৪.১২.২০২০ ১২:০৫ এএম  (ভিজিট : ৩৬৬)
একজন কবি তার পরিপার্শ্বকে দেখেন নিমগ্ন দার্শনিকের মতো গভীরতর অন্তর দৃষ্টিতে আর সৃজনী ভাষায় আঁকেন তার প্রিয় অভিভাষ্য। কবির ভালোলাগা-ভালোবাসার শোভন চিত্রকল্প। একজন কবি দেখেন, একজন বিজ্ঞানীও দেখেন। কবির দৃশ্যকল্পের সঙ্গে বিজ্ঞানীর দৃশ্যকল্প মেলে না, যদিও অনেক সময় কবির সত্য বিজ্ঞানের সঙ্গে একরেখায় মিলে যায়। কবি যখন বলেন : ‘শুধু কার্বন-ডাই-অক্সাইড নয়,/ নাও তুমি জ্বরতপ্ত জনসমুদ্রের আর নি¤œচাপের দাহ/ সব হলাহল আমূল মন্থন করো/ এই দেখো পুড়ে যাচ্ছিÑ পুড়ছে আমার বঙ্গদেশ।’ (বৃক্ষমঙ্গল-১৭)
বৃক্ষমঙ্গল কি মধ্যযুগের মঙ্গলকাব্যের কোনো স¤প্রসারণ কিংবা পুনরাবৃত্তি? প্রশ্নটিই অবচেতন মনে এসে যায়। না, এটি কোনো মধ্যযুগীয় দেবীর বরপ্রাপ্ত কবির কাব্যগাথা নয়, বরং অতিমাত্রায় সংবেদনশীল এক আধুনিক কবির আত্মার শৈল্পিক অভিব্যক্তি, যা আজকের সমাজ-বাস্তবতায় পুরোপুরি প্রাসঙ্গিক ও যৌক্তিক।
৭০ দশকের শক্তিমান ও শীর্ষস্থানীয় কবি নাসির আহমেদ বৃক্ষমঙ্গল (প্রকাশকাল ১৯৯৬ সাল) সা¤প্রতিক বাংলাকাব্যে বিষয় ও শিল্প প্রকরণগত দিক থেকে এক গুরুত্বপূর্ণ কাব্যগ্রন্থ। বৃক্ষমঙ্গল কাব্যে বৃক্ষ পেয়েছে নানামুখী মাত্রা। বৃক্ষ কখনও কবির চোখে প্রিয় স্বপ্নদায়িনী নারী, কখনও-বা জটিল যন্ত্রণাদগ্ধ নগরজীবনে কাক্সিক্ষত সেবাদায়িনী শুশ্রƒষাকারী। দগ্ধকবি বৃক্ষের কাছে বেঁচে থাকার মতো আশ্রয় চান, শুশ্রƒষা চান। বৃক্ষকে প্রিয়ার আসনে স্থিত করে তুমুল ভালোবাসায় কবি যখন উচ্চারণ করেন : ‘এতদিনে এসেছি তোমার কাছে/ও অরণ্য জ্যোৎস্নাস্নাত রাত্রির প্রতিমা/ রাশি রাশি পাতার মখমলে আমাকে আবৃত করো’Ñ তখন কবির এই প্রমিত পঙ্ক্তিগুলো প্রবলভাবে প্রাণিত করে আমাদের।
এ ভাষ্য শুধু কবির নয়, এ যেন বর্তমান মানব-অস্তিত্ব সঙ্কটের এক সত্যিকারের উচ্চারণ। আর এভাবেই কবি সত্যদ্রষ্টার মতো আমাদের সমাজ-সভ্যতার ভেতরে ক্রমশ প্রবেশ করেন, পাশ কাটিয়ে অন্যদিকে মুখ ফেরান না। মানুষের হিংসাদগ্ধ সমাজ-সংসারে মানবতার অভাববোধের প্রসঙ্গটি তখন স্পষ্ট থেকে স্পষ্টতর হয়ে ওঠে।



 কবির এ বীক্ষণ কোনো আরোপিত কৃত্রিম অভিবীক্ষণ নয়। এ যেন স্বতঃস্ফ‚র্ত সাদা চোখে দেখা হৃদয় চোখেরই বাস্তব ছবি-প্রতিচ্ছবি।
কী আশ্চর্য! আমাদেরই বাকি
তোমার আমার শুধু কাবিনের লেখাজোখা
বিবাহ হলো না আমাদের। (বৃক্ষমঙ্গল-৪)
কবির উচ্চারণ যেন আমাদের দাম্পত্য জীবনের নানা সঙ্কট ও বিশ্বাসহীনতার এক প্রতীকী ভাষ্য, প্রকৃতির তুলনায় মানুষের সীমাবদ্ধতার তো বটেই।
কবি নাসির আহমেদ নগরযন্ত্রণার জটিল ঘূর্ণাবর্তের সঙ্গে নিয়ত মুখোমুখি হচ্ছেন, বিমর্ষ হচ্ছেন একাকিত্বের অনিঃশেষ যন্ত্রণায়। তাইতো তিনি নগরযন্ত্রণার একাকিত্ব থেকে নিজেকে পৃথক করতে প্রাণপণ চেষ্টা করেছেন আর নাড়িতে অনুভব করেছেন, ‘দয়াবতী মায়ের স্নেহের মতো সেই বাঁশঝাড়’-এর স্নেহশীল মায়াবী আহŸান।
সমকালীন সমাজ-বাস্তবতা তথা রাজনীতি, এমনকি যুবসমাজের নৈতিক অবক্ষয়ের চিত্রও বৃক্ষমঙ্গলের ক্যানভাসে উঠে এসেছে। কবির কবিতা নীতিভ্রষ্ট যুবকের কারাবাস কিংবা শাস্তি দাবি করে না, বরং সস্নেহ ভালোবাসায় ট্রিটমেন্ট দিতে গিয়ে উচ্চারণ করেন :
‘ওদের পাঠিয়ে দাও অরণ্যের গহীন গভীর নির্বাসনে/ বৃক্ষদের স্নিগ্ধতায় ওরা মুগ্ধ হোক/ ওদের জ্বলন্ত চোখ, দূষিত নিঃশ্বাস কিছু ক্লোরোফিল চায়।’
কবির বিশ্বাস, এখনও মানবরচিত কৃত্রিম সভ্যতার উল্টো পিঠে নিসর্গ সভ্যতাকে ছুঁয়ে যায়Ñ যে জীবনে পাখির ডানা বিস্তৃত থাকে নিঃসীম নীলিমায়! ‘সাবমেরিনের চেয়ে প্রাণোচ্ছল গতি ছিল পানকৌড়ি ডাহুকের মগ্ন জলকেলি’ (বৃক্ষমঙ্গল-২৪)
চুয়ান্নটি কবিতা নিয়ে নাসির আহমেদের বৃক্ষমঙ্গলের সীমা-পরিসীমা। অধিকাংশ কবিতায় বৃক্ষ প্রসঙ্গ থাকলেও চব্বিশটি নির্ভেজাল কবিতা বৃক্ষ মগ্ন চৈতন্যের শব্দচ্ছবি। এ ছাড়া অন্যান্য কবিতায় দৈশিক-রাজনৈতিক-সমাজের সংশ্লিষ্ট এমনকি শিল্প-সাহিত্যের টুকরো সমাচারও উঠে এসেছে। রাশিয়া, সার্বিয়া, বসনিয়া, বার্লিন প্রাচীর ইত্যাদি সমকালীন গুরুত্বপূর্ণ প্রসঙ্গও। এমনকি এসেছে রিলকে, সিমাস হিনি প্রসঙ্গ। ‘একটি হারানো কবিতা’ শিল্পসফল অসাধারণ রচনা। ‘পাঁচ ফুট দুই ইঞ্চি উজ্জ্বল শ্যামল রং ঘন কালো চুলের কবিতা’র জন্য কবির উৎকণ্ঠ প্রতীক্ষা পাঠকের ফেলে আসা স্মৃতি মাথানত প্রিয়মুখ, প্রিয় স্মৃতির দরোজায় অনিঃশেষ করাঘাত যেন। কবি নাসির আহমেদকে প্রকৃত অর্থে খুঁজতে গেলে আমাদের বারবার বৃক্ষমঙ্গলের কাছে ফিরে যেতে হবে। বৃক্ষমঙ্গল প্রকৃতিপ্রেমী কবি নাসির আহমেদের প্রকৃতি, প্রেম ও জীবনের এক চিরস্থায়ী দলিল, অবিনাশী কাব্যসত্তা।




সর্বশেষ সংবাদ

সর্বাধিক পঠিত


ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: কমলেশ রায়, আমিন মোহাম্মদ মিডিয়া কমিউনিকেশন লিমিটেড এর পক্ষে প্রকাশক গাজী আহমেদ উল্লাহ
নাসির ট্রেড সেন্টার, ৮৯, বীর উত্তম সি আর দত্ত সড়ক (সোনারগাঁও রোড), বাংলামোটর, ঢাকা।

ফোন : +৮৮-০২-৯৬৩২৩৬৮-৭৪, ফ্যাক্স : +৮৮-০২-৯৬৩২৩৭৫ | ই-মেইল : shomoyeralo@gmail.com
close