ই-পেপার বৃহস্পতিবার ২ মে ২০২৪
বৃহস্পতিবার ২ মে ২০২৪

কষ্টেরা সোহানার  মতো
প্রকাশ: শুক্রবার, ১৮ ডিসেম্বর, ২০২০, ১১:১৯ পিএম  (ভিজিট : ২৬১)
সোহানাদের বাড়িটার সামনে আসলেই আবু হোসেন নিজেকে হারিয়ে ফেলে। এই বাড়িতে ছিল তার স্বপ্নের বীজ। প্রতিদিন এই বাড়ির সামনে না আসলে তার অস্থিরতা বেড়ে যেত। এই বাড়ির মেয়ে সোহানাই ছিল তার জিয়নকাঠি। প্রতিদিন একবার তাকে দেখা চাই। আবু যখন উতলা ওপক্ষ যেন শীতনিদ্রায়। আবুর চেষ্টা তাকে কোনো ফল দেখাচ্ছিল না। কিন্তু যেদিন আবু জানলো ওই পক্ষেও সমান জ্বালা সেদিন ছিল আবুর কঠিন পরীক্ষার দিন।
দিনটা আবু হোসেনের হৃদয়ে এখনও জগদ্দল পাথরের মতো চেপে আছে। ঘটনাটা এখনও তাকে স্বপ্নে তাড়িয়ে বেড়ায়। বিশেষ করে মাঝরাতে স্বপ্নটা বেশি জ¦ালাতন করে। যেন তার ব্যর্থতাকে মুখ ভ্যাঙচায়। স্বপ্নে হঠাৎ তার চারদিকে উজ্জ্বল আলোয় ভরে ওঠে। সে দেখে তার সামনে ভারী একটা ট্রাক এসে দাঁড়ায়। ট্রাক থেকে ঝাঁকড়া চুলওয়ালা মস্তু প্রথমে লাফ দিয়ে নেমে আসে। আবু হোসেন তাকে চিনতে পারে। তার সমস্ত হাত-পা কাঁপতে থাকে। মস্তু ডাকাতকে এলাকার ত্রাস হিসাবে সবাই চেনে। এমনিতে পাকিস্তানি আর্মির অত্যাচার, অন্যদিকে মস্তুর। মস্তুরা আস্কারা পেয়ে আরও বাড় বেড়েছে। আবু হোসেনের চোখের সামনেই মস্তু ডাকাত ওর লোকজন নিয়ে পাড়ার সবচাইতে সম্মানিত বাড়িতে ঢুকে পড়ে। এলাকার সকলে জানে পঁচিশে মার্চে ঢাকায় গণহত্যার প্রতিবাদে এই শহরে এ বাড়ি থেকেই প্রথম আওয়াজ উঠেছিল। আজ সে বাড়ি আক্রান্ত। কিছুক্ষণের মধ্যেই বাড়ির আশপাশে ভিড় জমে যায়। তারা দেখে মস্তুর লোকজন বাড়ির যুবতী কন্যাসহ সবাইকে টেনে হিঁচড়ে বের করে নিয়ে আসা হচ্ছে। আশপাশের সবাই প্রতিবাদহীন পাথরের মূর্তি হয়ে যেন তামাশা দেখছে। আবুও সেই ভিড়ের একজন। হঠাৎ সে লক্ষ করে ওর দিকে চোখ পড়তেই মেয়েটার সাহস যেন চ‚ড়ায় ওঠে। সে তাকে ধরে রাখা লোকটার হাতে প্রচÐ কামড় বসিয়ে নিজেকে ছাড়িয়ে নেয়। দৌড়ে এসে আবু হোসেনকে জড়িয়ে ধরে বাঁচার আকুতিতে চেঁচিয়ে ওঠে। ‘আবু আমাকে বাঁচাও, তুমি না আমাকে ভালোবাসো! আমি জানি তুমি আমাকে বাঁচাবে।’ যুবতীর কথায় আবু হোসেনের হৃদয়ে ছড়িয়ে যায় গন্ধরাজের সুগন্ধিধারা। কিন্তু তা বেশিক্ষণ স্থায়ী হয় না। রাইফেলের বাঁট আঘাত হানে আবু হোসেনের ঘাড়ে। আবু ছিটকে পড়ে দূরে। চোখের সামনে থেকে সবাইকে ট্রাকে উঠিয়ে নেয় মস্তু ডাকাত। কিন্তু আবুর শরীরে তখন কাজ করছে ভালোবাসার সালসা। সে শরীরে ও মননে আহত তবুও উৎকণ্ঠিত একটা আকর্ষণ আবু হোসেনকে শক্তি জোগায় এ অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে। সে মেয়েটাকে রক্ষার চেষ্টায় নিজেকে প্রস্তুত করে। দৌড়ে গিয়ে ট্রাক থেকে তাকে নামাতে চেষ্টা করে। কিন্তু মস্তুর লাথি তাকে আবারও পরাজিত করে। সাহায্যের আশায় আশপাশে দাঁড়িয়ে থাকা লোকগুলোর দিকে তাকায়। কিন্তু বৃথা চেষ্টা, কেউ এগিয়ে আসে না। অসহায় আবুর মনে হয়ে তার আশপাশে সে নিজে ছাড়া অন্যরা সবাই যেন পিঠে বয়সের কুঁজ বইছে। তার মনে হয়ে তাকে চতুর্দিক থেকে সঙ্গ দিচ্ছে যেন সেকেলে লোহার সিন্দুক, বেলোয়াড়ি ঝাড়, অদ্ভুত সব গালিচা। বীভৎস কণ্ঠে চিৎকার করে ওঠে আবু হোসেন। পাশে ঘুমিয়ে থাকা স্ত্রী ঝাঁকানি দিয়ে তাকে জাগায়। ‘কী হয়েছে তোমার, আবারও স্বপ্ন দেখেছ!’
‘হ্যাঁ কী করব বলো, স্মৃতি যে আমাকে স্থির থাকতে দেয় না। একাত্তর আমাকে শান্তিতে ঘুমোতে দেয় না।’ আবুর উত্তর।
স্ত্রী বুঝতে পারে তার স্বামীর কষ্টটা কোথায়। আলতো করে মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়Ñ ‘ভুলে যাও সব কষ্ট। তুমি তো বীর মুক্তিযোদ্ধা। তুমি যুদ্ধ করেছ। দেশ স্বাধীন করেছ। যুদ্ধে এমন কত কিছু হয়!’




আবুর চোখে পানি। বলল, ‘জানো, তিন দিন পর সোহানা ও তার পরিবারের সদস্যদের ক্ষতবিক্ষত লাশ খুঁজে পাই। ওদের তো কোনো দোষ ছিল না। ওরা তো অন্যায়ের বিরুদ্ধে কথা বলেছিল। অন্যায়ের বিরুদ্ধে কথা বলা কি পাপ? আর মেয়েরা! ওদের কী অপরাধ ছিল! জানো মিথী, সোহানাই আমার যুদ্ধে যাবার অনুপ্রেরণা ছিল। যুদ্ধ তো শুধু পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে ছিল না। যুদ্ধ ছিল দুর্নীতিমুক্ত, শোষণহীন সমাজের জন্য। মস্তুকে ঠিকই ধরেছিলাম। মুক্তিযোদ্ধাদের বিচারে তার মৃত্যুদÐও কার্যকর হয়েছিল। কিন্তু তবু কি নিজেকে ক্ষমা করতে পেরেছিলাম! পারিনি সেদিন সেই অসহায় পরিবারকে বাঁচাতে। সেদিনের সেই দৃশ্য যে আমি আজও ভুলতে পারি না।’
আবু যেদিন গ্রাম ছেড়ে যুদ্ধে যোগদানের জন্য যাচ্ছিল সে দিনটিও ছিল অদ্ভুত। আবুর কাছে মনে হচ্ছিল যেন ফ্যাকাশে দিনটা তার জন্য মুখ ভার করে রয়েছে। যতই সীমান্তের কাছে যাচ্ছিল তার কাছে মনে হচ্ছিল ওই তো একটু দূরেই শুভ্র স্বাধীন আকাশ। ক্যাম্পে যেতে পারলেই সামনে দেশসেবার ব্যবস্থা। আবুর এখনও মনে আছে, ক্যাম্পে পৌঁছে অনেকক্ষণ রাতের খোলা আকাশের নিচে বসেছিল। সুন্দর ঝকঝকে আশি^নের জ্যোৎ¯œা শুভ্র আকাশ। এমন মুক্ত আকাশে নিজ দেশে নিশ^াস ফেলার স্বপ্ন দেখে আবু। মাঝে মাঝে বেরসিক কালো উড়ন্ত মেঘ যেন হিংসায় ওই স্বাধীন রূপকে ঢেকে দেবার অপচেষ্টা করছে। ভেতরে ভেতরে কঠিন হতে থাকে আবু হোসেন। ট্রেনিং শেষে অস্ত্র হাতে প্রথম তার নিজের শপথ ছিল সোহানার কাছে। পাকিস্তানি হায়েনা আর সামজের ক্ষত মস্তুদেরকে শেষ করা।
বাকি রাতটা আর ঘুমোতে পারেনি আবু। নিঃশব্দে তার চোখ থেকে মাতমের অশ্রæ ঝরতে থাকে। স্ত্রীর সান্ত¡নাও তাকে তার কষ্ট থেকে দূরে রাখতে পারছে না।
‘মিথী!’ খুব ক্ষীণ কণ্ঠে স্ত্রীকে ডাকল আবু হোসেন। আবারও বলতে শুরু করল, ‘আমার কষ্টটা কোথায় জানো? পাকিস্তানিরা ছিল আমাদের চিহ্নিত শত্রæ, ওদেরকে টার্গেট করা কোনো বিষয় ছিল না। জানো প্রথম প্রথম ওরা আমাদেরকে বলত ‘বুজদিল (সাহসহীন) বাঙালি’। কিন্তু মুক্তি সেনার কেঁচকি মারের চোটে যখন হাগা-মুতা ছুটল তখন বুঝল বাঙালি কী জিনিস। জানো বউ, মেজাজ খিঁচড়ে যায় যখন দেখি পাকিস্তানিদের প্রেতাত্মারা এখনও এ দেশে রয়ে গেছে। এরাই জাতির কাছ থেকে বঙ্গবন্ধুকে কেড়ে নিয়েছে। বিষয়গুলো যখন মাথায় আসে নিজেকে স্থির রাখা কষ্টকর হয়ে যায়। ইচ্ছে করে আবারও অস্ত্র হাতে তুলে নিই।’
আবু হোসেনের স্ত্রী মিথীও মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের সন্তান। যুদ্ধের ক্ষত তার পরিবারেও রয়েছে। সে ভালোভাবেই তার স্বামীর কষ্টটা বোঝে। তাইতো সোহানার কথা জেনেও আবু হোসেনকে জীবনসাথি করেছে। বিয়ের পূর্বে আবুল হোসেনই তাকে সব খুলে বলেছিল। সব শুনে মিথী আপত্তি তো করেইনি বরং বীর মুক্তিযোদ্ধা আবু হোসেনকে আনন্দের সাথেই গ্রহণ করেছিল। স্বামীর কথায় তার চোখেও অশ্রæ বইতে থাকে।
স্বামীকে গভীর মমতায় বুকের সাথে চেপে ধরে। আলতো করে তার কপালে চুমু খেয়ে বলে, ‘নিশ্চিত থাকো, যত ষড়যন্ত্রই হোক, বাঙালি বীরের জাতি। বাঙালিকে দাবিয়ে রাখা এত সহজ না। বীরের রক্ত বীরের জ›ম দেয়। আর উকুন তো জ্ঞানীর মাথায়ই থাকে। ওদের মারতে কামান প্রয়োজন নেই, দুই নখের ডলাই যথেষ্ট।’




সর্বশেষ সংবাদ

সর্বাধিক পঠিত


ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: কমলেশ রায়, আমিন মোহাম্মদ মিডিয়া কমিউনিকেশন লিমিটেড এর পক্ষে প্রকাশক গাজী আহমেদ উল্লাহ
নাসির ট্রেড সেন্টার, ৮৯, বীর উত্তম সি আর দত্ত সড়ক (সোনারগাঁও রোড), বাংলামোটর, ঢাকা।

ফোন : +৮৮-০২-৯৬৩২৩৬৮-৭৪, ফ্যাক্স : +৮৮-০২-৯৬৩২৩৭৫ | ই-মেইল : shomoyeralo@gmail.com
close