ই-পেপার রোববার ২৮ এপ্রিল ২০২৪
রোববার ২৮ এপ্রিল ২০২৪

দিনে শতকোটির হুন্ডি
প্রকাশ: শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০২৪, ৮:০৯ এএম আপডেট: ২৯.০৩.২০২৪ ৮:১৩ এএম  (ভিজিট : ৪২৭)
বলা হয়ে থাকে প্রবাসীদের আয়ে বাংলাদেশের অর্থনীতির চাকা সচল রয়েছে। সেই সচল চাকায় বাগড়া বসিয়েছে ডিজিটাল মাধ্যমে হুন্ডি লেনদেন। বিশেষ অ্যাপ বা মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে প্রতিদিন অবৈধ লেনদেন হচ্ছে অন্তত শতকোটি টাকা। এভাবে ডিজিটাল মাধ্যমে হুন্ডি লেনদেন করায় সরকার হারাচ্ছে রাজস্ব আয়।

বাংলাদেশে ব্যাংকের ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (বিএফআইইউ) দায়িত্বশীল এক কর্মকর্তা জানান, অবৈধ ফরেক্স, বেটিং, ক্রিপ্টোকারেন্সির মাধ্যমে লেনদেন করায় গত বছর শতাধিক ওয়েবসাইট, ৬০টির বেশি সোশ্যাল মিডিয়া পেজ এবং ২৫টি অ্যাপ বন্ধ করা হয়। আমরা এ পর্যন্ত ১০ হাজার হুন্ডির বেনিফিশিয়ারির হিসাব জব্দ করেছি। এর মধ্যে প্রায় ৬ হাজার জনকে বৈধ পথে রেমিট্যান্স আনার শর্তে তাদের অ্যাকাউন্ট খুলে দেওয়া হয়েছে। আড়াই হাজার অ্যাকাউন্ট স্থায়ীভাবে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। বাকি দেড় হাজার অ্যাকাউন্টের তদন্ত চলমান রয়েছে।

তদন্ত সংশ্লিষ্টরা জানান, ডিজিটাল হুন্ডি চক্রের সঙ্গে জড়িত বড় বড় রাঘববোয়াল। তাদের অপকর্ম নিয়ন্ত্রণ করা খুব কঠিন। সরকার রাজস্ব থেকে যে পরিমাণ বঞ্চিত হচ্ছে তা অপূরণীয়। কারণ রেমিট্যান্সের মাধ্যমে সরকারের মোটা দাগের রাজস্ব আয় হয়। এমন বেশ কয়েকটি চক্রের সন্ধান পেয়েছে পুলিশের অপরাধী তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)। গতকাল বৃহস্পতিবার বিকালে এমনই এক চক্রের পাঁচ সদস্যকে গ্রেফতারের কথা জানিয়েছে সিআইডি। চক্রটি গত তিন মাসে জেট রোবটিক অ্যাপসের মাধ্যমে ৪০০ কোটি টাকা অবৈধ লেনদেনের তথ্য পেয়েছে সিআইডি।

তদন্ত সংশ্লিষ্টরা আরও জানান, বিদেশ থেকে সঠিক পথে আসা রেমিট্যান্স চক্রটির কারণে অবৈধ ডিজিটাল হুন্ডি হয়ে দেশে আসছে। আর এই হুন্ডি কারবারে সরাসরি জড়িত মোবাইল ব্যাংকিং কর্মকর্তা-কর্মচারীরা।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যানুযায়ী, প্রতি বছর প্রবাসীদের কাছ থেকে সরকারের আয় আসে অন্তত সোয়া ২০০ কোটি ডলার। তবে গত বছর এবং চলতি বছরের প্রথম তিন মাসে এই প্রবাসী আয় অনেক কমেছে। এর মধ্যে ২০২৩ সালে সরকার আয় করেছে ১৬৮ কোটি ৩৪ লাখ ডলার। আগের বছরের তুলনায় আয় কমেছে প্রায় ১৮ শতাংশ।

সিআইডির গোয়েন্দা সূত্র জানায়, অন্তত ১০ হাজার মোবাইল ব্যাংকিং হিসাবের বিরুদ্ধে তদন্ত চলছে। গত বছর যখন প্রবাসী আয় কমে যায়, তখনই গোয়েন্দাদের বিষয়টি অবহিত করে বাংলাদেশ ব্যাংক। দীর্ঘ তদন্তে এর সত্যতা পেয়েছে সিআইডি।

বাংলাদেশ ব্যাংকের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করে সময়ের আলোকে বলেন, ‘ব্যাংকের মাধ্যমে বৈধভাবে বিদেশ থেকে টাকা পাঠালে খরচ কিছুটা বেশি পড়ে। আর হুন্ডির মাধ্যমে খরচ কিছুটা কম। আরেকটি কারণ হলো, বৈধ পথে টাকা আসতে অন্তত ২৪ ঘণ্টা সময় লাগে। কিন্তু হুন্ডিতে একটা ফোন করতে যত সময় লাগে তার মধ্যেই টাকা চলে আসে। বৈধ পথে রেমিট্যান্স আনলে বর্তমানে আড়াই শতাংশ প্রণোদনা পাওয়া যায়। এই প্রণোদনা আরও বাড়ানো সময়ের দাবি। আসল কথা হলো, এমএফএসের সেবা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে হাতের কাছেই পাওয়া যায় এজেন্ট। ফলে মানুষ ব্যক্তিগত সুবিধার কারণে এই পথে যাচ্ছে।’

২০২২ সালের ৩ মে তদন্তের পর চট্টগ্রামের কোতোয়ালি থানায় ১৪ জনের বিরুদ্ধে মানি লন্ডারিংয়ের অভিযোগে মামলা করে চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশ। ওই মামলার অন্যতম আসামি ছিল আন্দরকিল্লার বিকাশ ডিস্ট্রিবিউটর মেসার্স আল-কাদের অ্যান্ড কোম্পানি। প্রতিষ্ঠানটি চার বছরে প্রায় ২ হাজার কোটি টাকার লেনদেন করে। ওই লেনদেনের সিংহভাগ সন্দেহজনক। ওই বিকাশ ডিস্ট্রিবিউটর ৪৬ কোটি ২ লাখ ১৭ হাজার ১২৫ টাকা পাচারের জন্য জমা করেছিল। এর কয়েক দিন আগে ফেনী জেলার বিকাশ ডিস্ট্রিবিউটর রিয়াদ আহমেদ রাজীবের সঙ্গে ফেনীর হুন্ডি চক্রের সংশ্লিষ্টতা পেয়েছে সিআইডি ও বিএফআইইউ। ওই বছরই তার প্রতিষ্ঠানে ৩ হাজার ৪৭০ কোটি ৩৪ লাখ টাকার সন্দেহজনক লেনদেন হয়েছে বলে মনে করছে আর্থিক গোয়েন্দারা। এর মধ্যে গত এক বছরে তার ব্যাংক হিসাবে জমা হয়েছে ৯২৫ কোটি টাকা। বিপুল এ অর্থের ৯৯ শতাংশ জমা হয়েছে নগদ টাকায়। এর মধ্যে বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট অন্তত ৩৪৬ কোটি টাকা হুন্ডির মাধ্যমে লেনদেন হওয়ার প্রমাণ পেয়েছে।

সিআইডি প্রধান অতিরিক্ত আইজিপি মোহাম্মদ আলী মিয়া সময়ের আলোকে বলেন, ‘চক্রটি বর্তমানে বিভিন্ন অ্যাপসের মাধ্যমে ডিজিটাল হুন্ডিতে টাকা পাঠাচ্ছে। আমরা এই চক্রটিকে খুঁজছি। চক্রটি শত শত কোটি টাকা ডিজিটাল হুন্ডির মাধ্যমে দেশে পাঠাচ্ছে। এতে সরকার এই খাত থেকে বিপুল রাজস্ব হারাচ্ছে।’ তিনি বলেন, ‘চক্রটি দুবাই, মালয়েশিয়া বসে এই হুন্ডি কারবার নিয়ন্ত্রণ করছে। আর দেশে যারা জড়িত তাদের চিহ্নিত করে গ্রেফতার করা হচ্ছে।’

গতকাল বিকালে এক সংবাদ সম্মেলনে মোহাম্মদ আলী মিয়া সাংবাদিকদের বলেন, ‘জেট রোবটিক অ্যাপসের মাধ্যমে অভিনব কৌশলে দেশে হুন্ডির মাধ্যমে পাঠানো ৪০০ কোটি টাকার সঙ্গে জড়িত চক্রের পাঁচ সদস্যকে গ্রেফতার করা হয়েছে। এই চক্র চট্টগ্রামের বিকাশ ডিস্ট্রিবিউশন হাউস তাসমিয়া অ্যাসোসিয়েটসের কাছ থেকে এজেন্ট সিম সংগ্রহ করে। এরপর ওই সিমগুলো মডেমের মাধ্যমে ল্যাপটপে/কম্পিউটারে কানেকশন দেয়। কানেকশন দেওয়ার পর অ্যাপসটির মাধ্যমে কানেকশনকরা সিমের কন্ট্রোল চলে যায় অ্যাপস নিয়ন্ত্রণকারী ব্যক্তির হাতে। যারা দুবাইয়ে বসে এই ডিজিটাল হুন্ডির কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণ করে।’

সিআইডি প্রধান আরও বলেন, ‘এই হুন্ডি চক্রের মূল হোতা শহিদুল ইসলাম ওরফে মামুন ২০২০ সাল থেকে দুবাই অবস্থান করছে। সেখানে বসে মামুনসহ আরও পাঁচজন জেট রোবটিক অ্যাপসটি নিয়ন্ত্রণ করে। মালয়েশিয়ান সফটওয়্যার ডেভেলপারের মাধ্যমে তৈরি করা এই অ্যাপস কাস্টমাইজ করে নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রাখে চক্রটি। এ কারণে এজেন্ট সিমগুলো বাংলাদেশে থাকলেও এর নিয়ন্ত্রণ দুবাই বসে করা হয়। দুবাই বসেই তারা বাংলাদেশের বিভিন্ন নম্বরে ক্যাশ-ইনের মাধ্যমে অর্থ পাঠায়।’

এই হুন্ডির কাজে তারা প্রবাসী বাংলাদেশিদের কাছ থেকে এজেন্টের মাধ্যমে বৈদেশিক মুদ্রা সংগ্রহ করে। সংগ্রহ করা অর্থ কোন নম্বরে বা ব্যাংক অ্যাকাউন্টে পাঠাতে হবে তা জেনে নেয়। এরপর বাংলাদেশ থেকে সংগ্রহ করা এজেন্ট সিম দিয়ে অ্যাপস ব্যবহার করে প্রবাসীদের আত্মীয়দের নম্বরে অর্থ পাঠায় চক্রটি। এই চক্র চট্টগ্রামের চাঁদগাঁও এলাকার বিকাশ ডিস্ট্রিবিউশন হাউস তাসমিয়া অ্যাসোসিয়েটের ১৫০টি এজেন্ট সিম ব্যবহার করেছে।

সিআইডি প্রধান জানান, গত জানুয়ারি থেকে চলতি মার্চ পর্যন্ত চক্রটি অন্তত ৪০০ কোটি টাকা হুন্ডি করেছে।

গতকাল চট্টগ্রামে অভিযান চালিয়ে ডিজিটাল হুন্ডির সঙ্গে সরাসরি জড়িত পাঁচজনকে গ্রেফতার করেছে সিআইডির সাইবার পুলিশ সেন্টার। গ্রেফতাররা হলেন-মো. নাসিম আহেমেদ (৬২), ফজলে রাব্বি সুমন (৩২), মো. কামরুজ্জামান (৩৩), মো. জহির উদ্দিন (৩৭) এবং মো. খায়রুল ইসলাম ওরফে পিয়াস (৩৪)। এ সময় তাদের কাছ থেকে ৬টি মোবাইল ফোন, ১৮টি সিমকার্ড, ১টি ল্যাপটপ, ৬টি মডেম ও নগদ ২৮ লাখ ৫১ হাজার ২০০ টাকা জব্দ করা হয়।

সময়ের আলো/আরএস/ 




https://www.shomoyeralo.com/ad/1698385080Google-News-Update.jpg

সর্বশেষ সংবাদ

সর্বাধিক পঠিত


ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: কমলেশ রায়, আমিন মোহাম্মদ মিডিয়া কমিউনিকেশন লিমিটেড এর পক্ষে প্রকাশক গাজী আহমেদ উল্লাহ
নাসির ট্রেড সেন্টার, ৮৯, বীর উত্তম সি আর দত্ত সড়ক (সোনারগাঁও রোড), বাংলামোটর, ঢাকা।

ফোন : +৮৮-০২-৯৬৩২৩৬৮-৭৪, ফ্যাক্স : +৮৮-০২-৯৬৩২৩৭৫ | ই-মেইল : shomoyeralo@gmail.com
close