ই-পেপার বৃহস্পতিবার ২ মে ২০২৪
বৃহস্পতিবার ২ মে ২০২৪

মাতৃদুগ্ধ ব্যাংক এবং তার প্রতিক্রিয়া
প্রকাশ: রবিবার, ২৯ ডিসেম্বর, ২০১৯, ১২:০০ এএম আপডেট: ২৮.১২.২০১৯ ৯:৫০ পিএম  (ভিজিট : ২৬৮)
খোলা জানালা দেখলে কেউ উঁকি দেয়, কেউ ঢিল মারে, কেউ নালিশ জানায়। অন্যের বাড়ির দিকে তাক করা জানালা খোলা হবে কেন? কারও কৌত‚হল হয়, কারও রাগ হয়। ঢিল মেরে অন্য বাড়ির মানুষকে ঘায়েল করার অবাধ্য ইচ্ছে হয়। অধিকার বোধের কথা তুলে গালাগালি করতেও বাধে না কারও। কিন্তু কেউ বলে না, ওর নিজের বাড়ির জানালা খোলার অধিকার আছে। টাটকা বাতাস পাওয়ার প্রয়োজন আছে তার। দিনে নীল আকাশ এবং রাতে তারার দীপালি দেখার শখ আছে তার। আসলে বলতে চেয়েছি, খোলা জানালা একটা প্রতীক। সব ভালোর প্রতীক। খোলা জানালা মানে ভরপুর জীবন। মুক্ত আলোময় জীবন। যেখানে মানুষের জীবন এবং মানবতাই মূল কথা। তাই দেখা যায়, বদ্ধ জীবনে মারাত্মক শ^াসকষ্টের সময় মানবতার কল্যাণ কামনায় হঠাৎ কেউ একটা নতুন সংগঠন করার ডাক দিলে ঝাঁপিয়ে পড়ে সচেতন মানুষ। নতুন লোক ছাড়াও অন্য দল থেকেও মানুষ আসতে চায়। মনে আশা, নতুন কথা শোনা যাবে। নতুন দর্শনের সন্ধান পাওয়া যাবে। যেখানে ‘চেতনা’ আর ‘মুক্তিযুদ্ধ’ শব্দ বিক্রি করার কথা কেউ বলবে না। যেখানে উদ্দেশ্যমূলকভাবে সত্যিকার মুক্তিযোদ্ধাকে রাজাকার বা যাকে তাকে রাজাকার বলে মানুষের জীবন অতিষ্ঠ করার খেলা হবে না। যেখানে মানবতার কথা বলবে ভালো মানুষেরা। তা সে যেকোনো সংগঠন
হতে পারে। ভালো কথা বলার অধিকার সবার আছে।
গৌরচন্দ্রিকা এজন্য যে, কদিন আগেই দৈনিক পত্রিকায় এবং ফেসবুকে দেখেছি ‘মাতৃদুগ্ধ ব্যাংক’ করার একটা উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। ভাবলাম, মহৎ উদ্যোগ। সুস্থ দশার একটা জানালা খুলে যাবে এবার। পরক্ষণেই চিন্তিত হয়েছি, আমাদের দেশে ভেজালে বিশেষজ্ঞ কিছু উচ্চমানের ব্যবসায়ী এখানে না চুনের পানি বা পুকুরের দূষিত পানি ব্যবহার করে অথবা ময়দা গোলা পানি মেশায়। কারণ মানুষের জীবনের দাম এখানে নেই বললেই চলে। তামাশা করার জন্য বন্ধুকে পেটাতে পেটাতে মেরে ফেলাটাও এখানে খেলা হয়ে উঠছে। ধর্ষণ তো নস্যি, ধর্ষণের পর হত্যা করাটাও একটা হিম্মতের ব্যাপার হয়ে উঠছে। শিশু পাচার, ডাস্টবিনে নবজাতক পাওয়া, হাসপাতালে পরিত্যক্ত শিশু পাওয়া, এখন আর বিশেষ খবর নয়। সেখানে ভাগ্যহত নবজাতকের জন্য ‘মাতৃদুগ্ধের ব্যাংক’ করা হবে, এ খবরটা আমাকে আনন্দে উদবেলিত করেছিল।
কত শিশু জন্মলগ্নেই মাকে হারায়। কত রুগ্ণ মা বাচ্চাকে দুধ খাওয়াতে পারে না। কত অকালে জন্ম নেওয়া শিশু অপুষ্ট থাকার জন্য মায়ের দুধ টানতেই পারে না। কখনও নানা অসুখের কারণে মায়ের বুকে সুধা নামে না। তখন সদ্যোজাত শিশুকে বাঁচিয়ে রাখাটাই হয়ে যায় প্রাণান্ত। তা ছাড়া চাকরি করেন এমন মায়েদের শিশুর সংখ্যাও কম নয়। সেই বিপদকালে যদি মায়ের দুধ পাওয়া যায় তাকে খাওয়ানোর জন্য, তাহলে সেটা সুখবর নিশ্চয়। শিশুর জন্য মায়ের দুধের চেয়ে উৎকৃষ্ট খাদ্য আর কিছু নেই।
কদিনের মধ্যে কী হলো, ‘মাতৃদুগ্ধ ব্যাংকের’ প্রতিবাদে অনেকের কণ্ঠ শোনা গেল। তাদের বক্তব্য হলো, এটা হারাম কাজ। কারণ? দুধ ভাইবোনে বিয়ে হবে না। হাসব না কাঁদব? প্রশ্ন হলো, জন্মের সঙ্গে সঙ্গেই তার বিয়ের হিসেব করতে হবে কেন? আগে তো বাচ্চাটা বাঁচুক। বড় হোক। আর যারা এই দায়িত্বপূর্ণ কাজ করতে চাইছেন, তারা নিশ্চয় বিজ্ঞানসম্মতভাবে পুরো কাজটার আয়োজন করবেন। কার কার দুধ নেওয়া হচ্ছে, তাদের ঠাঁই ঠিকানা থাকবে স্বচ্ছভাবে। তা ছাড়া কেউ তো কাউকে ব্যাংকের দুধ খাবার জন্য বাধ্য করবে না। যাদের প্রয়োজন, তারাই আসবেন ছুটে। নবজাতকের জন্য অন্য মায়ের দুধ ‘হারাম, হারাম’ বলে চিৎকার চেঁচামেচি করার দরকার কী?
আমাদের দেশে ‘দুধমা’-এর ব্যাপারটা বরাবরই ছিল। একান্নবর্তী পরিবারের অনেক শিশুকে চাচি, ফুফু, খালার বুকের দুধ খাওয়ানো হয়েছে বাঁচিয়ে রাখার জন্য। এক হাসপাতালে দেখেছি, জন্মলগ্নে মা মারা যাওয়া শিশু পাশের বেডের মায়ের দুধ খেয়েছে। জানি না তারা কোনো ঠিকানা রেখেছেন কি না? সচেতন হলে রেখে
থাকবেন। না রাখলে দায়, তাদেরই।
আমাদের নবীজিরও (সা.) ‘দুধমা’ ছিল। সম্ভ্রান্ত পরিবারে ‘দুধমা’ থাকাটা একসময় আভিজাত্যেরও নমুনা ছিল। সম্ভ্রান্ত কোরাইশ বংশের সন্তান হিসেবে মা আমিনার সন্তান, পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ মহামানব, দুনিয়ার শেষ এবং শ্রেষ্ঠ নবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর জন্যও ছিলেন ‘দুধমা’। মা ফাতিমা ছাড়াও মা হালিমার দুধপান করেছেন তিনি। দুধমাকে অত্যন্ত সম্মান করতেন নবীজি। তাকে দেখলে দাঁড়িয়ে সম্মান প্রদর্শন করতেন। এসব কথা আমরা জানি। তারপরও ঢালাওভাবে কেমন
করে বলা যায়, অন্য মায়ের দুধ, বাচ্চার জন্য নয়?
মানুষের ক্ষেত্রে, প্রথম চাহিদা হলো বেঁচে থাকা। যার পরিবারে সদ্যোজাত বাচ্চার জন্য অন্য মায়ের দুধ প্রয়োজন হয়, তারা মুসলমান হলে নিশ্চয় সেই দুধমায়ের ঠাঁই ঠিকানা রাখবে। নিজ দায়িত্বেই রাখবে। অন্য ধর্মের কথা আমি জানি না। তবে লোকসাহিত্যে ‘ধাইমা’ শব্দ পাওয়া যায়। এই ‘ধাইমা-ই’ তো ‘দুধমা’। তাদের দুধ সন্তানদের নিয়ে কত মানবিক গল্প শুনেছি এবং পড়েছি। এটা নিষিদ্ধ হলে যুগ যুগ ধরে ‘দুধমা’-এর মহানুভবতার কথা শুনতাম না আমরা।
বøাড ব্যাংকের কথাই ধরা যাক না। ধর্মাধর্ম, বর্ণ, গোত্র, সাদা কালো, নারী পুরুষ, নির্বিশেষে রক্ত সংরক্ষণ করা হয়। প্রয়োজনে সেটা দিয়ে জীবন বাঁচানো হয় মানুষের। মানুষকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য আজকাল অঙ্গ প্রত্যঙ্গ প্রতিস্থাপন করা হয়। কেউ তো আপত্তি তোলে না? কার অঙ্গ, কার দেহে যায়, কোন ধর্ম বা বর্ণের মানুষের অঙ্গ কোন ধর্ম বা বর্ণের মানুষের দেহে যুক্ত করা হয়, তা নিয়ে কিন্তু হারাম হালালের প্রশ্ন তোলে না কেউ। ওঠে না জাত-বেজাতের কথাও। তখন জীবনটাকে বাঁচিয়ে রাখাই সবচেয়ে বড় চিন্তা। শুধু এই নয়, বাঁদরের অঙ্গ প্রতিস্থাপনের
কথাও বিজ্ঞানীরা ফেলে দিতে পারছেন না। জীবন রক্ষার জন্য আধুনিক বিজ্ঞানের এমন অলৌকিকপ্রায় স্বাস্থ্য প্রযুক্তিকে স্বাগত জানাচ্ছেন সব ধর্মমতের অভিজাত এবং অনভিজাত মানুষ। এই অপূর্ব সুন্দর পৃথিবীতে সবাই বেঁচে থাকতে চায়। শুধু একবারের জন্য পাওয়া এই অমূল্য জীবনই মানুষের সবচেয়ে প্রিয়।
বিজ্ঞান এবং প্রযুক্তির সৌজন্যে আজকাল ঋষিমাতার (সারোগেট মাদার) মাধ্যমেও মানুষ সন্তানের আকাক্সক্ষা পূরণ করছে। টিউব বেবি নিচ্ছে বন্ধ্যা দম্পতিরা।
কোথাকার এবং কার প্রাণ পরমাণু কতদিন সংরক্ষিত রাখার পর কোন মাতৃগর্ভে নোঙর ফেলছে, তার হিসাব নিয়ে হালাল হারামের প্রশ্ন তুলছে কি কেউ? অনেক সময় শেকড়ের সন্ধানও পাওয়া যায় না। তবু সন্তান পেয়েই খুশি শত শত মা-বাবা। এসব তথ্য তো সত্য। তা ছাড়া, সারাদিনে আমরা অনেকেই তো কত নিষিদ্ধ কাজ করছি। আমরা অভুক্তকে রেখে পেট পুরে খাই। প্রতিবেশী দুস্থকে রেখে নিজে আনন্দ উৎসব করি। ভেজাল দেই, ওজনে কম দেই, সুদ খাই, পরের টাকা মেরে দেই, দুর্নীতি করি, বিষ দিয়ে অন্যের পুকুর ভরা মাছ মেরে ফেলি, বাগানের কলাগাছের কলাগুলোকে অর্ধেক করে কেটে রাখি। এর কোনটা শুদ্ধ কাজ?
কাজেই প্রথম অনুরোধ হলো, ‘মাতৃদুগ্ধ ব্যাংকের’ ব্যাপারে ইতিবাচক এবং পরম কল্যাণকর চিন্তা করেন। একই সঙ্গে, প্রকল্প পরিচালনার ব্যাপারে আন্তরিকতার সঙ্গে সব ধরনের তথ্যাদি সংরক্ষণের ব্যাপারে পরামর্শ দেন। যেকোনো নতুন প্রকল্প, যার সঙ্গে ধর্মের বিধি-বিধান আদেশ-নির্দেশের সম্পর্ক আছে, যার সঙ্গে দেশাচারের ইতিহাস মিশে আছে, সেগুলো নিয়ে যুক্তিভিত্তিক আলোচনা করতে হবে। একুশ শতকের উচ্চ বিজ্ঞান এবং প্রযুক্তির কালে মানুষের জীবনের মূল্যবোধ বদলে গেছে। যদিও মানুষ আগের চেয়ে অনেক বেশি আত্মপর হয়েছে, অনেক বেশি সাংঘর্ষিক হয়েছে, তবু জীবনকেই ভালোবাসে সবচেয়ে বেশি। জীবন বাঁচানো ফরজ। তাই মনে করি, অগণিত শিশুর জীবনের কথা চিন্তা করে ‘মাতৃদুগ্ধ প্রকল্পের’ যে আয়োজন করা হচ্ছে, তার মধ্যে আছে প্রভ‚ত মানবিক কল্যানচিন্তা। মানবতা দিয়েই তাকে বিচার করতে হবে, গ্রহণ করতে হবে।

শিক্ষাবিদ, সাবেক অধ্যাপক
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়




সর্বশেষ সংবাদ

সর্বাধিক পঠিত


ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: কমলেশ রায়, আমিন মোহাম্মদ মিডিয়া কমিউনিকেশন লিমিটেড এর পক্ষে প্রকাশক গাজী আহমেদ উল্লাহ
নাসির ট্রেড সেন্টার, ৮৯, বীর উত্তম সি আর দত্ত সড়ক (সোনারগাঁও রোড), বাংলামোটর, ঢাকা।

ফোন : +৮৮-০২-৯৬৩২৩৬৮-৭৪, ফ্যাক্স : +৮৮-০২-৯৬৩২৩৭৫ | ই-মেইল : shomoyeralo@gmail.com
close