ই-পেপার বুধবার ১ মে ২০২৪
বুধবার ১ মে ২০২৪

স্থায়ী শান্তির অন্বেষণে পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমি কমিশন আইন সংশোধন সময়ের দাবি
প্রকাশ: রবিবার, ২৯ ডিসেম্বর, ২০১৯, ১২:০০ এএম আপডেট: ২৮.১২.২০১৯ ৯:৫০ পিএম  (ভিজিট : ৩৮৮)
পার্বত্য চট্টগ্রামে যত সমস্যা আছে তার মধ্যে অন্যতম প্রধান সমস্যা হলো ভ‚মি সংক্রান্ত সমস্যা। সেই সমস্যা নিরসনে সরকার বেশ আন্তরিকতার সঙ্গে কাজ করে যাচ্ছে। এ লক্ষ্যে সরকার ইতোমধ্যে পার্বত্য চট্টগ্রাম ভ‚মি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন গঠন করেছে। ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম ভ‚মি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন (সংশোধন) অধ্যাদেশ-২০১৬’ সরকারের একান্ত আন্তরিকতারই ফসল। তবে পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসরত বাঙালি জনগোষ্ঠী এই ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম ভ‚মিবিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন (সংশোধন) অধ্যাদেশ- ২০১৬’ কে স্বাগত জানালেও ওই অধ্যাদেশের বেশ কিছু ধারা নিয়ে তারা শঙ্কিত। কারণ বাঙালিদের ধারণা এই কমিশন গঠন করে সরকার পার্বত্য ভ‚মি বিরোধ নিষ্পত্তি করার সদিচ্ছা দেখালেও যাদের দাবির প্রেক্ষিতে এগুলো করা হয়েছে তাদের উদ্দেশ্য কিন্তু ভিন্ন।
এ বিষয়ে ৪ আগস্ট ২০১৬ তারিখে ঢাকায় এক মানববন্ধন কর্মসূচিতে মেজর জেনারেল (অব.) সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম বীরপ্রতীক বলেন, ‘১৯৮৭ সালে পার্বত্যাঞ্চলের এসব দেশদ্রোহীরা সরকারকে প্রস্তাব দিয়েছিল পুরো বাংলাদেশ দুটি ভাগে ভাগ করার। এক ভাগের নাম বাংলাদেশÑ যার রাজধানী ঢাকা। আরেক ভাগের নাম হবে ‘জুম্মল্যান্ড’Ñ যার রাজধানী রাঙামাটি। এই দুটি অংশ মিলে একটি ফেডারেল সরকার হবে। তখন আমরা রাজি হইনি। কিন্তু বর্তমান এই ভ‚মি আইন বাস্তবায়নের ফলে দেশদ্রোহীদের সেই স্বপ্ন বাস্তবায়ন হবে’। পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসরত বাঙালিদের ধারণা, ভ‚মি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন আইন-২০১৬ সংশোধনীর ফলে পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে বাঙালিদের উচ্ছেদ করার নিরঙ্কুশ ক্ষমতা পেয়ে যাবেন পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির সভাপতি সন্তু লারমা। আর কমিশনকে ব্যবহার করে সন্তু লারমা কোনো বাঙালি পরিবারকে পার্বত্য চট্টগ্রামে তার ভিটেমাটি থেকে উচ্ছেদ করলেও কোনো আইন-আদালত কিংবা রাষ্ট্রের প্রতিকার করার ক্ষমতা থাকবে না।
কেন বাঙালিদের এই শঙ্কা সে বিষয়ে কিছুটা আলোকপাত করা প্রয়োজন : পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসরত অর্ধেক জনগোষ্ঠীই বাঙালি অথচ পার্বত্য চট্টগ্রাম ভ‚মি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন (সংশোধন) আইন-২০১৬ বাস্তবায়নের লক্ষ্যে যে কমিশন গঠন করা হয়েছে সেখানে পার্বত্য বাঙালিদের কোনো প্রতিনিধি নেই। আইনে সেই সুযোগ রাখা হয়নি। কমিশনের ৯ জন সদস্যের মধ্যে তিনজন সার্কেল চিফ, তিনজন পার্বত্য জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান এবং একজন আঞ্চলিক পরিষদের চেয়ারম্যান সবাই উপজাতি। বাকি দুজন তথা কমিশনের চেয়ারম্যান একজন অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি ও সদস্য চট্টগ্রাম বিভাগীয় কমিশনারÑ তারা সরকারের প্রতিনিধি। ফলে ভ‚মি নিয়ে বেশিরভাগ বিরোধ যাদের মধ্যে তাদের একটি পক্ষ কমিশনে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠ হলেও অপরপক্ষ পার্বত্য বাঙালিরা সম্পূর্ণ অনুপস্থিত। অধিকন্তু, কমিশনের সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যদের মতামতের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত গৃহীত হওয়ার আইন থাকায় এ কমিশন থেকে একপেশে যেকোনো ধরনের সিদ্ধান্ত আসার আশঙ্কা বাঙালিদের।
তাই পার্বত্য চট্টগ্রামের বসবাসরত বাঙালিরা এ আইন ও কমিশনের মাধ্যমে তাদের ভ‚মির অধিকার হারাবে বলে উৎকণ্ঠিত। এ ধরনের একপেশে সিদ্ধান্তের ফলে পার্বত্য বাঙালিরা ভ‚মিহীন হয়ে যেতে পারে বলেও তারা আশঙ্কা করছে।
কমিশন আইনের ১৬নং অনুচ্ছেদে বলা আছে যে, ‘ধারা-৬(১)-এ বর্ণিত কোনো বিষয়ে দাখিলকৃত আবেদনের ওপর কমিশন প্রদত্ত সিদ্ধান্ত দেওয়ানি আদালতের ডিক্রি বলিয়া গণ্য হইবে, তবে ওই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে কোনো আদালত বা অন্য কোনো কর্তৃপক্ষের নিকট আপিল বা রিভিশন দায়ের বা উহার বৈধতা বা যথার্থতা সম্পর্কে কোনো প্রশ্ন উত্থাপন করা যাইবে না।’ এ ধারার মাধ্যমে বাঙালি ও উপজাতি সবাই তাদের সাংবিধানিক অধিকার থেকে বঞ্চিত হবে। শুধু তাই-ই নয়, এ ধারা উচ্চ আদালতের এখতিয়ারকে ক্ষুণœ করেছে এবং এভাবে সাংবিধানের সঙ্গেও সাংঘর্ষিক।
এ ছাড়াও, ৬(১)(ক) ধারা মোতাবেক ভ‚মি সংক্রান্ত বিরোধ প্রচলিত আইন, রীতি ও পদ্ধতি অনুযায়ী নিষ্পত্তি করতে বলা হয়েছে। পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রচলিত আইন, রীতি ও পদ্ধতি মূলত হেডম্যন, কারবারি এবং সার্কেল চিফদের ব্যক্তিগত মতামত ও সিদ্ধান্তকে বোঝানো হয়। কিন্তু পার্বত্য চট্টগ্রামে হেডম্যান, কারবারি ও সার্কেল চিফ সবাই উপজাতি ফলে তারা উপজাতিদেরই স্বার্থ রক্ষায় কাজ করবে বলে সহজেই অনুমেয়।
তাই এটি নিশ্চিত যে, সংশোধিত আইনের ৬(১)(ক) ধারাটি অপব্যবহার করে বাঙালিদেরকে তাদের নিজেদের বসতভিটা, জায়গা জমি থেকে বঞ্চিত ও উচ্ছেদ করার সুযোগ পাবে। বিশেষজ্ঞদের কথা হলোÑ যেসব ক্ষেত্রে দেশে পর্যাপ্ত আইনের অস্তিত্ব রয়েছে সেসব ক্ষেত্রে প্রচলিত রীতি ও প্রথার প্রয়োগ থাকতে পারে না। মূলত ১৯৭২ সাল থেকে পার্বত্য চট্টগ্রামের স্বায়ত্তশাসন দাবি করে আসা একটি বিশেষ উপজাতি গোষ্ঠীর লালিত স্বপ্ন পার্বত্য চট্টগ্রামকে বাংলাদেশ থেকে বিচ্ছিন্ন করে ‘জুম্মল্যান্ড’ নামক একটি স্বতন্ত্র ও স্বাধীন রাষ্ট্র গঠন করার উদ্দেশ্যেই এই ধারা সংযোজন করা হয়েছে বলে ধারণা করা যায়।
পাশাপাশি, ৬(১)(খ) ধারা মোতাবেক আবেদনে উল্লিখিত ভ‚মিতে আবেদনকারী বা ক্ষেত্রমত সংশ্লিষ্ট প্রতিপক্ষের, স্বত্ব বা অন্যবিধ অধিকার পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রচলিত আইন, রীতি ও পদ্ধতি অনুযায়ী নির্ধারণ এবং প্রয়োজনবোধে দখল পুনর্বহাল করতে বলা হয়েছে যা বাংলাদেশ সংবিধানের ২৭ (সকল নাগরিক আইনের দৃষ্টিতে সমান এবং আইনের সমান আশ্রয় লাভের অধিকারী), ৩১ (আইনের আশ্রয়লাভ এবং আইনানুযায়ী ও কেবল আইনানুযায়ী ব্যবহার লাভ যেকোনো স্থানে অবস্থানরত প্রত্যেক নাগরিকের এবং সাময়িকভাবে বাংলাদেশে অবস্থানরত অপরাপর ব্যক্তির অবিচ্ছেদ্য অধিকার এবং বিশেষত আইনানুযায়ী ব্যতীত এমন কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করা যাইবে না, যাহাতে কোনো ব্যক্তির জীবন, স্বাধীনতা, দেহ, সুনাম বা সম্পত্তির হানি ঘটে), ৪২ (আইনের দ্বারা আরোপিত বাধা-নিষেধ সাপেক্ষে প্রত্যেক নাগরিকের সম্পত্তি অর্জন, ধারণ, হস্তান্তর বা অন্যভাবে বিলি-ব্যবস্থা করিবার অধিকার থাকিবে এবং আইনের কর্তৃত্ব ব্যতীত কোনো সম্পত্তি বাধ্যতামূলকভাবে গ্রহণ, রাষ্ট্রায়ত্ত বা দখল করা যাইবে না) এবং ১০২নং অনুচ্ছেদের সঙ্গে সরাসরি সাংঘর্ষিক। ভ‚মি কমিশন আইনে ওই ধারা সংযোজন এবং অধ্যাদেশ ২০১৬-তে তার সংশোধনের মাধ্যমে ভ‚মিতে স্থানীয় বাঙালিদের অর্জিত দলিলসমূহের আইনি ও বৈধ মূল্য সম্পূর্ণরূপে অস্বীকার করা হয়েছে এবং হীন উদ্দেশ্যে স্থানীয় বাঙালিদের ভ‚মিতে অর্জিত দলিলসমূহ বাতিলের গভীর ষড়যন্ত্র করা হয়েছে।
৬(১)(গ) ধারাটি সংশোধোনের ফলে জলে ভাসা জমি বিশেষ করে কাপ্তাই হ্রদে ভেসে ওঠা জমিসহ অন্যান্য জমির ওপর একতরফাভাবে উপজাতিদের অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। ওই জমিতে কোনো বাঙালি বন্দোবস্ত পেয়ে থাকলেও তা থেকে তাদের বাধ্যতামূলকভাবে উচ্ছেদ করতেই আইনে এই সংশোধনী আনা হয়েছে। অথচ, বন্দোবস্ত, লিজ, কবুলিয়ত ইত্যাদি আইনি পরিভাষায় শুধু খাস জমি বণ্টনের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য এবং খাস জমির মালিক হচ্ছে সরকার। এক্ষেত্রে নাগরিক বা সম্প্রদায়ের হস্তক্ষেপ বেআইনি। ফলে পার্বত্য চট্টগ্রামের ৩০ ভাগ ভ‚মিতে বসবাসরত বাঙালি জনগোষ্ঠীর বসতভিটার পাশাপাশি রিজার্ভ ফরেস্ট, সরকারি শিল্প-কারখানা, সেনানিবাস, বিজিবি, পুলিশ ব্যারাক, ডিসি অফিস, এসপি অফিস, ভ‚মি অফিস, আদালতসহ সব ধরনের সরকারি প্রতিষ্ঠানের জন্য ভ‚মি বন্দোবস্তও অবৈধ বলে প্রমাণিত হবে। এ অবস্থায় পার্বত্য ভ‚মি কমিশন আইন সংশোধন করে ওই কমিশনে জনসংখ্যা অনুপাতে পাহাড়ে বসবাসরত সব জনগোষ্ঠীর প্রতিনিধির উপস্থিতি ও সমান মতামত নিশ্চিত না করা হলে পার্বত্য চট্টগ্রামের ভ‚মি সমস্যার প্রকৃত সমাধান হবে না।
বরং বৃহত্তর জনগোষ্ঠী বাঙালিরা ভ‚মির অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়ে পড়লে পাহাড়ের পরিস্থিতি আরও জটিল আকার ধারণ করবে। এতে পার্বত্য চুক্তির যে কাক্সিক্ষত লক্ষ্য ‘শান্তি প্রতিষ্ঠা’ তা চরমভাবে ব্যাহত হবে। উপরন্তু সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক ধারাসমূহ, রাষ্ট্রের অধিকার ও কর্তৃত্বের সঙ্গে চ্যালেঞ্জিং ধারাসমূহ সংশোধন না করলে পার্বত্য চট্টগ্রামে সরকারের অধিকার, মর্যাদা ও কর্তৃত্ব ক্ষুণœ হবে। বিশেষ করে সন্তু লারমা ও তার অনুসারীরা ধারাবাহিকভাবে পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে বাঙালিদের এবং সেনা ক্যাম্পগুলো সরিয়ে নেওয়ার যে দাবি তুলে আসছে বিদ্যমান অবস্থায় এই কমিশনের মাধ্যমে তার সে দাবি পূরণের পথ প্রশস্ত হবে।
তাই এখন উচিত পার্বত্য চট্টগ্রামের অর্ধেক জনগোষ্ঠী তথা বাঙালিদের ভ‚মি ও সাংবিধানিক অধিকার প্রতিষ্ঠা এবং পার্বত্য চট্টগ্রামের অখÐতা রক্ষার স্বার্থে পার্বত্য চট্টগ্রাম ভ‚মি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন আইন সংশোধন করে সব জনগোষ্ঠীর মাঝে গ্রহণযোগ্য একটি ভ‚মি কমিশন গঠনের উদ্যোগ নেওয়া। একই সঙ্গে আইন সংশোধন না হওয়া পর্যন্ত কমিশনের সব কার্যক্রম স্থগিত রাখা। বিগত বেশ কিছুদিন যাবৎ পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসরত বাঙালিরা তাদের ভ‚মি হারানোর আশঙ্কায় পার্বত্য চট্টগ্রাম ভ‚মিবিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন (সংশোধন) আইন-২০১৬-এর এসব বিতর্কিত ও সংবিধান পরিপন্থি ধারাসমূহের সংশোধনের দাবিতে তিন পার্বত্য জেলায় সভা, সমাবেশ, মানববন্ধন, প্রধানমন্ত্রী বরাবর স্মারকলিপি প্রদান ইত্যাদি কর্মসূচি পালন করে যাচ্ছে। আইনের সংশোধনী না হলে ভবিষ্যতে বাঙালিদের এসব কর্মসূচি আরও তীব্রতর আকার ধারণ করে পার্বত্য চট্টগ্রামের সার্বিক পরিস্থিতি আরও অস্থিতিশীল ও জটিল হতে পারে। কাজেই কর্তৃপক্ষের উচিত পার্বত্য চট্টগ্রাম ভ‚মিবিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন-২০১৬-এর বিতর্কিত, একপেশে এবং সংবিধান পরিপন্থি ধারাগুলো শিগগিরই সংশোধন করা। নতুবা যে শান্তির অন্বেষণে ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তিচুক্তি করা হয়েছিল তা অধরাই থেকে যাবে।

লেখক রাঙামাটির বাসিন্দা






সর্বশেষ সংবাদ

সর্বাধিক পঠিত


ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: কমলেশ রায়, আমিন মোহাম্মদ মিডিয়া কমিউনিকেশন লিমিটেড এর পক্ষে প্রকাশক গাজী আহমেদ উল্লাহ
নাসির ট্রেড সেন্টার, ৮৯, বীর উত্তম সি আর দত্ত সড়ক (সোনারগাঁও রোড), বাংলামোটর, ঢাকা।

ফোন : +৮৮-০২-৯৬৩২৩৬৮-৭৪, ফ্যাক্স : +৮৮-০২-৯৬৩২৩৭৫ | ই-মেইল : shomoyeralo@gmail.com
close