ই-পেপার বৃহস্পতিবার ২ মে ২০২৪
বৃহস্পতিবার ২ মে ২০২৪

ভাসানচরে যেতে চায় ৩শ রোহিঙ্গা পরিবার
প্রকাশ: বৃহস্পতিবার, ২৬ নভেম্বর, ২০২০, ১১:১৭ পিএম আপডেট: ২৬.১১.২০২০ ১২:০২ এএম  (ভিজিট : ১১৫)
কক্সবাজারের উখিয়া-টেকনাফের শরণার্থী শিবিরগুলো থেকে ‘৩০০ রোহিঙ্গা পরিবার’ স্বেচ্ছায় ভাসানচরে যেতে ইচ্ছা প্রকাশ করেছে। এসব পরিবারের সদস্য সংখ্যা হাজারখানেক। এসব পরিবারকে সব প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে দ্রুতই সেখানে নিয়ে যাওয়া হতে পারে। শরণার্থী, ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার কার্যালয়ের একটি সূত্র এ তথ্য জানিয়েছে। তবে এ বিষয়ে সরকারের কোনো কর্মকর্তা আনুষ্ঠানিকভাবে কোনো তথ্য দিতে রাজি হয়নি।
মিয়ানমার সেনাবাহিনীর অব্যাহত হামলা, নিপীড়ন ও হত্যাকাণ্ড চালানোর কারণে ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট দেশ ছেড়ে বাংলাদেশে এসে আশ্রয় নেয় সাড়ে সাত লাখেরও বেশি রোহিঙ্গা। এ ছাড়া এর আগেও বাংলাদেশে এসে আশ্রয় নিয়েছিল বিপুলসংখ্যক রোহিঙ্গা। বর্তমানে তাদের সংখ্যা কমপক্ষে ১১ লাখ। বাংলাদেশ সরকার জাতিসংঘ ও অন্যান্য দেশের সহায়তায় কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফে ক্যাম্প নির্মাণ করে আশ্রয় দিলেও তাদের ফিরিয়ে নিতে মিয়ানমারের প্রতি বরাবরই দাবি জানিয়ে আসছে। এ বিষয়ে জোরালো আন্তর্জাতিক চাপ সৃষ্টিরও চেষ্টা চালাচ্ছে সরকার। এরপরও আশ্রয় দেওয়ায় তাদের মানবিক নানা সুযোগ-সুবিধার বিষয়টিও সরকারকে ভাবাচ্ছে। তাই রোহিঙ্গাদের  উখিয়া ও টেকনাফের ঘিঞ্জি ক্যাম্পগুলো থেকে সরিয়ে আরও নিরাপদে রাখতে নোয়াখালীর বিচ্ছিন্ন দ্বীপ ভাসানচরে নিজস্ব অর্থায়নে বিপুল ব্যয়ে আশ্রয় ক্যাম্প নির্মাণ করে যেখানে কমপক্ষে ১ লাখ রোহিঙ্গা বসবাস করতে পারবে।
সম্প্রতি রোহিঙ্গা নেতাদের ভাসানচরে নিয়ে গিয়ে দ্বীপ এবং সেখানে নির্মিত অবকাঠামো তাদের ঘুরিয়ে দেখানো হয়। এরপর এ নেতাদের অনেকে নানা ধরনের মত প্রকাশ করলেও ঘিঞ্জি বস্তিতে কষ্টে দিনযাপন করা রোহিঙ্গাদের অনেকেই ভাসানচরে আশ্রয় গ্রহণের বিষয়ে ভেতরে ভেতরে আগ্রহ দেখাচ্ছে এবং নিজেদের মধ্যে আলোচনা চালাচ্ছে। বেশ কয়েকজন রোহিঙ্গা নেতাও ভাসানচরে যাওয়ার বিষয়ে তাদের লোকজনকে ইতিবাচক মনোভাব দেখিয়েছে। এরপর অন্তত ৩০০ রোহিঙ্গা পরিবার শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার কার্যালয়ে ধাপে ধাপে এসে ভাসানচরে যাওয়ার বিষয়ে নিজেদের আগ্রহের কথা জানায়। এরপরই তাদের সেখানে পাঠানোর বিষয়ে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ অব্যাহত রেখেছে সরকার।
একটি সূত্র জানায়, রোহিঙ্গাদের এই দলটিকে নিরাপদে ভাসানচরে পাঠাতে পারলে আরও অনেক পরিবার সেখানে যাওয়ার বিষয়ে প্রকাশ্যে আগ্রহ প্রকাশ করবে বলে সরকার আশাবাদী। তবে ভাসানচরে রোহিঙ্গাদের এই দলটিই প্রথম আশ্রয়ের জন্য যাচ্ছে না। এর আগে গত মে মাসে অবৈধভাবে সমুদ্রপথে মালয়েশিয়া পৌঁছানোর চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়ে দুই দফায় নারী-শিশুসহ মোট ৩০৬ জন রোহিঙ্গা বাংলাদেশে ফিরে আসে। করোনাভাইরাসের সংক্রমণ রোধে সঙ্গনিরোধে রাখার কথা বলে সরকার তাদের ভাসানচরে নিয়ে রেখেছে।
অন্যদিকে নতুন রোহিঙ্গা পরিবারগুলোকে ভাসানচরে পাঠাতে মঙ্গলবার শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনারের কার্যালয়ের সরকারি ওয়েবসাইটে ভাসানচরের জন্য ফুড ও নন-ফুড আইটেম চাহিদাপত্রের নমুনা সংযোজিত হয়েছে। এরই মধ্যে বিভিন্ন এনজিও ভাসানচরে রোহিঙ্গাদের স্থানান্তরের পর সম্ভাব্য সহায়তা কার্যক্রম পরিচালনার জন্য প্রকল্প (ফুড ও নন-ফুড) জমা দেওয়ার কথা সরকারকে জানিয়েছে। এ ছাড়া জাতিসংঘ ও আন্তর্জাতিক সহায়তা সংস্থাগুলোর আপত্তির কারণে এখন পর্যন্ত কক্সবাজার থেকে সেখানে কোনো রোহিঙ্গা স্থানান্তর হয়নি। তবে কক্সবাজার থেকে ভাসানচরে যাওয়ার জন্য প্রথম ধাপে প্রায় তিনশ রোহিঙ্গা পরিবারের হাজারখানেক মানুষ রাজি হয়েছে বলে জানিয়েছেন সরকারের কর্মকর্তারা।
নাম প্রকাশ না করে তারা জানিয়েছেন, টেকনাফ ও উখিয়ার ঘিঞ্জি পরিবেশে জীবনযাপনের মধ্যে তাদের জন্য নির্মিত ভাসানচরে আবাসন প্রকল্প দেখে মুগ্ধ হয়ে রোহিঙ্গারা রাজি হচ্ছে। ভাসানচরে যেতে রাজি হয়েছে এমন পরিবারগুলোর একটি তালিকা পাওয়ার কথা স্বীকার করেছেন বাংলাদেশ শরণার্থী, ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কার্যালয়ের এক কর্মকর্তা।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এ কর্মকর্তা বলেন, ‘ভাসানচর, রোহিঙ্গাদের কাছে যেটি ঠেঙ্গার চর নামে পরিচিত, ওই দ্বীপে যেতে রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবির থেকে এখন বেশ সম্মতি পাওয়া যাচ্ছে, এটি ভালো লক্ষণ। প্রথম দফায় তিনশ পরিবারের হাজারখানেক রোহিঙ্গাকে সেখানে নিয়ে যাওয়া হতে পারে। তবে এর জন্য দিনক্ষণ এখনও চূড়ান্ত হয়নি।’
সর্বশেষ চলতি মাসের গত ১৬ নভেম্বর ২২টি এনজিওর কর্মকর্তাদের নিয়ে ৩২ সদস্যের একটি প্রতিনিধিদল ভাসানচর ঘুরে এসে জানিয়েছিল, ভাসানচরে রোহিঙ্গাদের বসবাসের খুবই উপযোগী পরিবেশের সৃষ্টি করা হয়েছে। সেখানে তাদের স্বাচ্ছন্দ্য জীবনযাপন এবং জীবিকাসহ দুর্যোগ মোকাবিলায় পর্যাপ্ত ব্যবস্থা রয়েছে। কক্সবাজারে বর্তমানে যেভাবে রোহিঙ্গারা মানবেতর জীবনযাপন করছে, তার চেয়ে অনেক ভালো থাকবে ভাসানচরে।
সরকার কাউকে জোর করে ভাসানচরে পাঠাবে না বলে মন্তব্য করে অতিরিক্ত শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার (আরআরআরসি) মোহাম্মদ সামছু-দৌজা বলেন, ‘বিভিন্ন শরণার্থী শিবির থেকে স্বেচ্ছায় কিছু রোহিঙ্গা পরিবার ভাসানচরে যেতে রাজি হয়েছে। তাদের তালিকা করে আমরা গুরুত্ব দিয়ে কাজ করছি। তাদের কখন ভাসানচরে হস্তান্তর করা হবে সে বিষয়ে এখনও দিন ঠিক হয়নি। কিন্তু কত পরিবার ভাসানচরে যেতে রাজি হয়েছে সেটি এখন নির্দিষ্ট করে বলা যাচ্ছে না।’
অন্যদিকে গত ২০ নভেম্বর এক বিবৃতিতে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল জানায়, জাতিসংঘের মতে ভাসানচর এখনও মানুষের বসবাসের উপযোগী নয়। তবে এই দাবি নাকচ করেছে সরকার। সংস্থাটির এই দাবির জন্য সরকারের চিন্তা পরিবর্তন হবে না বলে গণমাধ্যমে জানিয়েছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আবদুল মোমেন। তার মতে, ‘বিষয়টি নিয়ে এমন উদ্বেগের কোনো ভিত্তি নেই।’
আরআরআরসি কার্যালয় থেকে জানা গেছে, ‘সরকার রোহিঙ্গাদের ভাসানচরে পাঠানোর বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে দেখছে। ফলে রোহিঙ্গাদের বসবাস উপযোগী পরিবেশ গড়ে তুলতে সব ধরনের প্রস্তুতি শেষ করেছে। তারই অংশ হিসেবে ভাসানচরে হস্তান্তরের আগে সেখানকার নিরাপত্তা দেখভালের জন্য ১৪ নভেম্বর ওই দ্বীপের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি দেখতে যান আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের প্রধান অতিরিক্ত পুলিশ মহাপরিদর্শক (অ্যাডিশনাল আইজিপি) মোশারফ হোসেনের নেতৃত্বে পুলিশ, এপিবিএন ও নৌ-পুলিশের মোট ১১ জন প্রতিনিধিদল।
এর আগে গত সেপ্টেম্বরের দ্বিতীয় সপ্তাহে নোয়াখালীর হাতিয়ার ভাসানচরের আবাসন ব্যবস্থা বসবাসের উপযোগী কি না, তা দেখতে উখিয়া-টেকনাফ শিবিরের দুই নারীসহ ৪০ জন রোহিঙ্গা নেতাকে নিয়ে যায় সরকার। তারা ভাসানচরের আবাসন ব্যবস্থা দেখে ‘মুগ্ধ’ হলেও ফিরে এসে জানায়, সেখানে বসবাসকারী রোহিঙ্গারা কক্সবাজারে আসার জন্য আকুতি জানিয়েছিল তাদের কাছে। এ ছাড়া গত ১৪ অক্টোবর সরকারের উদ্যোগে একদল দেশি-বিদেশি গণমাধ্যমকর্মী ভাসানচর পরিদর্শন করেন। তবে সে সময় তাদের সঙ্গে সেখানে থাকা রোহিঙ্গাদের দেখা হয়নি।
উখিয়ার থাইংখালী রোহিঙ্গা শিবিরের হেড মাঝি মো. মুজিব উল্লাহ বলেন, ‘ভাসানচরের আবাসনের চিত্র দেখে তার শিবির থেকে স্বেচ্ছায় কিছু রোহিঙ্গা পরিবার যেতে রাজি হয়েছে। তাদের তালিকা ক্যাম্প কর্তৃপক্ষকে দেওয়া হয়েছে। এখন পর্যন্ত চল্লিশ পরিবারের নাম দেওয়া হয়েছে। তবে তাদের কখন নিয়ে যাওয়া হবে সেটি জানা যায়নি। এ ছাড়া তার আশপাশের ক্যাম্প থেকেও আরও কিছু রোহিঙ্গা যেতে রাজি হয়েছে বলে খবর রয়েছে।’
অন্যদিকে ভাসানচরে রোহিঙ্গাদের বরাদ্দ দেওয়ার কাজে নিয়োজিত হতে এনজিওগুলোও আবেদন করেছে। উখিয়া রোহিঙ্গা ক্যাম্পের রশিদা খাতুন বলেন, ‘সাত মাস ধরে ভাসানচরে আটকা রয়েছে আমার দুই সন্তান। তাই সরকারের কাছে ভাসানচরে নিয়ে যাওয়ার তালিকায় আমার নাম দিয়েছি। কারণ সেখানে আমার সন্তানদের নিয়ে বসবাস করতে পারব।’
শরণার্থী, ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনারের প্রতিনিধি এবং উখিয়া বালুখালীর তানজিমা খোলা রোহিঙ্গা শিবিরের কর্মকর্তা পুলক কান্তি চক্রবর্তী বলেন, ‘আমার শিবির থেকে কিছু রোহিঙ্গা পরিবার স্বেচ্ছায় ভাসানচরে যেতে রাজি হয়েছে। তাদের তালিকা তৈরি করে আরআরআরসি কার্যালয়ে পাঠানো হয়েছে।’
সম্প্রতি ভাসানচর পরিদর্শন শেষে চট্টগ্রাম রেঞ্জের পুলিশের উপ-মহাপরিদর্শক (ডিআইজি) মো. আনোয়ার হোসেন বলেছেন, ‘ভাসানচরে নিরাপত্তার বিষয়টি পুলিশ দেখভাল করছে। ফলে সেখানে পুলিশের একটি ব্যাটালিয়ন নির্মাণ করা হবে। আরও নিরাপত্তা বাড়াতে দ্বীপ ঘুরে দেখে সেখানকার কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলোচনা হয়েছে।’
রোহিঙ্গা নেতারা ভাসানচরের সৌন্দর্য ও স্থাপনা দেখে খুশি হয়ে শিবিরে প্রচারণা জোরদার করায় রোহিঙ্গারা স্বেচ্ছায় ভাসানচরে যেতে রাজি হচ্ছে বলে মন্তব্য করেছেন শরণার্থী, ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনারের প্রতিনিধি ও টেকনাফের শালবন ও জাদিমুরা রোহিঙ্গা শিবিরের কর্মকর্তা (সিআইসি) মোহাম্মদ খালিদ।
রোহিঙ্গাদের স্থানান্তরের জন্য নিজস্ব তহবিল থেকে ২ হাজার ৩১২ কোটি টাকা ব্যয়ে ভাসানচরে আশ্রয় প্রকল্প বাস্তবায়ন করেছে সরকার। জোয়ার ও জলোচ্ছ্বাস থেকে সেখানকার ৪০ কিলোমিটার এলাকা রক্ষা করতে ১৩ কিলোমিটার দীর্ঘ বাঁধ এবং ১ লাখ রোহিঙ্গা বসবাসের উপযোগী ১২০টি গুচ্ছগ্রামের অবকাঠামো তৈরি করা হয়েছে। গত বছরের ডিসেম্বরে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের এক সভায় ভাসানচরের জন্য নেওয়া প্রকল্পের খরচ ৭৮৩ কোটি টাকা বাড়িয়ে তিন হাজার ৯৫ কোটি টাকা করা হয়। বাড়তি টাকায় বাঁধের উচ্চতা ১০ ফুট থেকে বাড়িয়ে ১৯ ফুট করা, আনুষঙ্গিক সুবিধা বৃদ্ধিসহ জাতিসংঘের প্রতিনিধিদের জন্য ভবন ও জেটি নির্মাণে খরচ হবে।
প্রসঙ্গত, ২০১৫ সালে প্রথম ভাসানচরে শরণার্থীদের বসবাসের জন্য আবাসন গড়ার পরিকল্পনা করা হয়। এরপর কক্সবাজারের ওপর চাপ কমাতে ভাসানচরে অবকাঠামো গড়ার উদ্যোগ নেওয়া হয়।








সর্বশেষ সংবাদ

সর্বাধিক পঠিত


ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক: কমলেশ রায়, আমিন মোহাম্মদ মিডিয়া কমিউনিকেশন লিমিটেড এর পক্ষে প্রকাশক গাজী আহমেদ উল্লাহ
নাসির ট্রেড সেন্টার, ৮৯, বীর উত্তম সি আর দত্ত সড়ক (সোনারগাঁও রোড), বাংলামোটর, ঢাকা।

ফোন : +৮৮-০২-৯৬৩২৩৬৮-৭৪, ফ্যাক্স : +৮৮-০২-৯৬৩২৩৭৫ | ই-মেইল : shomoyeralo@gmail.com
close