আজিজ মার্কেটের মাঝখানের সিঁড়ি দিয়ে দোতলায় উঠলে ডানদিকের প্রথম দোকানটাতে বুদ্ধিজীবী আহমদ ছফাকে পাওয়া যেত। চিন্তামূলক গদ্য প্রবন্ধের পাশাপাশি অনেক উপন্যাস ও গানও তিনি লিখেছেন। ২০০০ সালের দিকে তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন, একটি শ্রেষ্ঠ কবিতার বই বের করবেন। আজিজ মার্কেটের প্রকাশকরা আহমদ ছফার নানান পাগলামির সঙ্গে আগে থেকেই পরিচিত। শ্রেষ্ঠ কবিতার উদ্যোগটিকে তারা ছফা ভাইয়ের নতুন পাগলামি হিসেবে বিবেচনা করলেন। ফলে, কেউ বইটাই প্রকাশ করতে রাজি হচ্ছিলেন না।
সেখানে আড্ডা দিতে আসতেন শিবনারায়ণ দাস। আমরা বলতাম শিবুদা। মার্কেটের পেছন দিকের কোনায় ১৯৯৬ সালে ইফতেখার হোসেন ও শিবনারায়ণ দাস একসঙ্গে অন্তরে রেস্তোরাঁ শুরু করেছিলেন। প্রায় দুই দশক ধরে বাংলাদেশের প্রায় সব কবি সাহিত্যিক বুদ্ধিজীবীর চা-নাশতা আড্ডার প্রধান কেন্দ্র ছিল এই অন্তরে রেস্টুরেন্ট। সেই সঙ্গে শিবুদার একটা শৌখিন প্রকাশনী ছিল, শ্রীপ্রকাশ। আহমেদ ছফার শ্রেষ্ঠ কবিতার সংকলনটি শ্রীপ্রকাশ থেকে প্রকাশিত হয়।
একটু একরোখা প্রকৃতির লোক ছিলেন শিবনারায়ণ দাশ। তার স্ত্রী বাংলাদেশ রেডিওতে প্রথম শ্রেণির কর্মকর্তা ছিলেন। চিকিৎসার জন্য ভারতে যেতে চাইলে ছুটি না দেওয়ায় একপর্যায়ে স্ত্রীকে ওই চাকরি থেকে ছাড়িয়ে নেন শিবনারায়ণ। ছাত্রজীবনে জাসদ করতেন। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার ৩৫ আসামির ১৭তম ছিলেন তিনি। কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজে টানানো তৎকালীন প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খানের ছবি পদদলিত করার কারণে তার বিরুদ্ধে হুলিয়া জারি করা হয়।
১৯৭০ সালের ৭ জুন তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের রাজধানী ঢাকার পল্টন ময়দানে ছাত্রদের এক সামরিক কুচকাওয়াজে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অংশ নেওয়ার কথা ছিল। সেজন্য ছাত্রদের নিয়ে জয় বাংলা বাহিনী গঠন করা হয়। ছাত্রনেতারা একটি পতাকা তৈরির সিদ্ধান্ত নেন। ১৯৭০ সালের ৬ জুন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন ইকবাল হলের (বর্তমান সার্জেন্ট জহুরুল হক হল) ১০৮ নং কক্ষে বাংলাদেশের জাতীয় পতাকার প্রাথমিক নকশাটি করা হয়। সেখানে সবার মতামত অনুযায়ী সবুজ পটভূমিতে লাল সূর্যের মাঝে হলুদ বাংলাদেশের মানচিত্র সংবলিত পতাকার নকশাটি চূড়ান্ত করা হয়। নকশা করার পরপর ওইদিন রাতেই নিউমার্কেট থেকে কাপড় কিনে প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন কায়দে আজম হলে (এখন তিতুমীর হল) জাতীয় পতাকার কাজ শুরু হয়। পরে শেরেবাংলা হলে শিবনারায়ণ দাস-শিবুদার দক্ষ হাতে পরিসমাপ্তি হয়। তার আঁকার হাত খুব ভালো ছিল বলেই তাকে এই দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলায় ১৯৭১ সালের ২ মার্চ প্রথম পতাকা তোলা হয়। পতাকাটি প্রথম উত্তোলন করেন ছাত্রনেতা ও ডাকসুর তৎকালীন ভাইস প্রেসিডেন্ট আ স ম আবদুর রব। বিজয়ের পর ১৯৭২ সালে শিবনারায়ণ দাসের ডিজাইন করা পতাকার মাঝে মানচিত্রটি বাদ দিয়ে পতাকার মাপ, রং ও তার ব্যাখ্যা-সংবলিত একটি প্রতিবেদন দিতে বলা হয় পটুয়া কামরুল হাসানকে।
২ মার্চ দিনটিকে উদযাপন করা হয় জাতীয় পতাকা দিবস হিসেবে। অন্যদিকে ১৯৭১ সালের ২৩ মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ধানমন্ডির বাসার সামনে শিবনারায়ণ দাসের ডিজাইন করা পতাকাই উত্তোলন করেন।
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তান সেনাবাহিনী কুমিল্লায় প্রথম আক্রমণ চালায় তাদের বাগিচাগাঁওয়ের বাসায়। তাকে না পেয়ে তার বাবাকে ধরে নিয়ে যায়। সে রাতেই তাকে হত্যা করা হয়। শিবনারায়ণকে ধরার জন্য দশ হাজার টাকা পুরস্কার ঘোষণা দিয়ে মাইকিং করা হয়। ঘটনার সময় তিনি শাসনগাছায় দলীয় কর্মীদের নিয়ে গাড়ির টায়ার পুড়িয়ে রাস্তায় ব্যারিকেড দিচ্ছিলেন। স্বাধীনতার আগে মুক্তিকামী মানুষের পতাকা ছিল গাঢ় সবুজ জমিনের ভেতর লাল সূর্য। আর সূর্যের মাঝে হলুদ রঙে আঁকা বাংলাদেশের মানচিত্র। ১৯৭০ সালের উত্তাল দিনগুলোতে এবং একাত্তরের রণাঙ্গনে এই পতাকা হয়ে দাঁড়ায় স্বাধীন বাংলার প্রতীক।
২০০১ সালের মার্চে তার সাক্ষাৎকার নিতে যোগাযোগ করি। তিনি সরাসরি নাকচ করে দেন। প্রায় নিভৃত জীবনযাপন করেছেন সাধারণ মানুষের মতো। শেষদিকে নানা ব্যাধি বাসা বেঁধেছিল তার শরীরে। বরাবরই লোকচক্ষুর আড়ালে থেকে গেছেন বাংলাদেশের ঐতিহাসিক পতাকাটির নকশাকার শিবনারায়ণ দাস।
সরকারি নথিপত্র, পাঠ্যপুস্তক বা গণমাধ্যমেও বরাবর উপেক্ষিত থেকে গেছেন পতাকার নকশাকার শিবনারায়ণ দাসের নামটি। শুক্রবার ঢাকার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালে শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা শিবনারায়ণ দাসের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে তার পরিবারকে শোক জানিয়েছেন।
বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর বেশ কিছুদিন শিবনারায়ণের তৈরি পতাকাই সরকারিভাবে চালু ছিল। ১৯৭২ সালে সেই পতাকা থেকে হলুদ রঙে আঁকা বাংলাদেশের মানচিত্রটি সরিয়ে দেওয়া হয়। পরে শিবনারায়ণ নানান সময়ে বলেছেন, ওই সিদ্ধান্ত সঠিক ছিল। কারণ পতাকায় মানচিত্র আঁকা সহজ কাজ ছিল না। ভুল হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা ছিল। তাতে জাতীয় পতাকার অমর্যাদা হতো। বাংলাদেশের প্রথম পতাকার রূপকার শিবনারায়ণ দাসের মৃত্যুতে জানাই শোক ও শ্রদ্ধা।
সহকারী সম্পাদক, সময়ের আলো