প্রকাশ: বৃহস্পতিবার, ৭ নভেম্বর, ২০১৯, ১২:০০ এএম (ভিজিট : ১২১)
বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বন্ধ হয়ে গেলে কেমন হয়? নিজে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র হিসেবে বলছি, সময় টাকা জীবন সবকিছুর অপচয় কমবে। উচ্চ মাধ্যমিকের পর সরাসরি বিসিএস ও পিএসসির এক্সাম। বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষা আর চাকরির পরীক্ষা যখন হুবহু এক, তখন মাঝের সময়টা ‘অকাজের’ জিনিস মুখস্থ করে লাভ কি? আমার অবস্থা পরিষ্কার করতে একটা উদাহরণ দিই। ইংরেজি বা বাংলায় স্নাতকোত্তর শেষ করে একজন ইউএনও/ বন বিভাগের কর্মকর্তা/ কোম্পানির ভালো পদে/ কোনো মন্ত্রণালয়ে চাকরি পান জগতের যাবতীয় খুচরা তথ্য মুখস্থ করে। ৩৬৫ দিনের মুখস্থ জ্ঞান ভুলে যেতে সময় লাগে ৩০ দিন। মনে থাকে কেবল প্রাইমারি আর হাইস্কুলের শিক্ষাটা। বাড়তি যুক্ত হয় বিশ্ববিদ্যালয়ে মার খাওয়া অথবা মার দেওয়ার স্মৃতি। যারা এ দলে পড়ে না, তাদের স্মরণীয় কোনো স্মৃতিই থাকে না। বিশ্ববিদ্যালয়ে যে ছাত্রছাত্রী বাংলা কিংবা ইংরেজি থেকে খুব ভালো ফলাফল করে (আর কিছুটা ক্ষমতা বা অর্থের সহযোগিতা নিতেও পারে, নাও পারে) শিক্ষক হলো, সে অধিকাংশ ক্ষেত্রে শিল্প-সাহিত্যের মানুষ না। আমি রাবির ইংরেজি বিভাগে ভর্তি হলাম সাহিত্যের স্কুলিংয়ের জন্য। অর্ধেক শিক্ষক সিলেবাসের বাইরে সাহিত্য বলতে কিছু বোঝে না। কেউ সৃজনশীল লেখক নন, মৌলিক গবেষণায় কারও কোনো অবদান নেই। ইংরেজি ভাষার গ্রামার (ইএলটি) ছাড়া কি শেখাবেন? দর্শন বিভাগ দিয়ে কি দেশে দর্শনচর্চা হয়? প্রতিবছর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে যদি ৩ হাজার ছাত্র দর্শনে উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করে বের হন, তারা কি করেন? বিজ্ঞানের অবস্থা আরও করুন। পদার্থ+রসায়ন+জীব বিজ্ঞানে উচ্চশিক্ষা শেষ করে বিভিন্ন দেশের রাজধানী ও মুদ্রার নাম মুখস্থ করে ইতিহাস/দর্শন/অর্থনীতি/বাংলা/ইংরেজিতে স্নাতকোত্তর শেষ করা ছাত্রদের সঙ্গে সরকারি বা বেসরকারি একই চাকরির জন্য লড়তে। এখানেও যারা শিক্ষক হবেন, তাদের দেশে বিজ্ঞানচর্চায় কোনো মৌলিক অবদান থাকবে না। তাদের কাজ ছাত্র পড়ানো। এ কাজ না করে তারা যদি দেশের প্রশাসনে কাজ করত, কোনো ক্ষতি হতো দেশের? বিশ্ববিদ্যালয় নাকি উচ্চতর পর্যায়ের জ্ঞানচর্চা ও গবেষণার জায়গা। হয় কিছু? শত শত বিশ্ববিদ্যালয়, প্রতিদিন হাঙ্গামা ছাড়া আর কোনো জাতীয় কিংবা আন্তর্জাতিক অর্জনের খবর তৈরি করে? তাই বলি কি, জাহাঙ্গীরনগর বন্ধ হয়েছে, অন্যগুলোও হোক, বছরখানেক সব বন্ধ রেখে পরীক্ষামূলক দেখা যাক, দেশের জ্ঞানচর্চা ও গবেষণায় কি ধস নামে! এই ১ বছর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা বেকার হয়ে যাবেন বলে একটা সমস্যার সৃষ্টি হতে পারে। এক্ষেত্রে সেখানে উচ্চফলনশীল সবজি, হাঁস, মুরগি, মৎস্য এসবের খামার করা যেতে পারে। কীটনাশকবিহীন খাদ্য উৎপাদন করে দেশের বিশুদ্ধ খাবারে অবদান রাখবে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো, ভাবা যায়! তখন দেখবেন, এই মহান কাজের জন্য আমাদের কোনো শিক্ষক নোবেলও পেয়ে যেতে পারেন। শান্তি অথবা ইউনি-আগ্রোতে দ্বিতীয়টা নোবেলে যুক্ত নেই, হবে--আমি তো কোনো সমস্যা দেখি না; আপনার সমস্যা কি? আমি অনেক শিক্ষককে জানি যারা অর্থনৈতিক নিরাপত্তার জন্য শিক্ষকতা পেশায় গেছেন, তারা লাভ বেশি দেখলে ১ বছর পর আর বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাস নেওয়ার মতো ‘বিরক্তিকর’ কাজে ফিরে আসতে চাইবেন না। আর যারা সত্যিকার অর্থে শেখানো ও নিজে শেখার জন্য শিক্ষক হয়েছেন, যদিও তাদের সংখ্যা বেশি হওয়ার কথা না, তাদের স্কুলে নিয়োগ দেওয়া হবে। কারণ, প্রকৃত শিক্ষাদানের কাজটা তখন, আমার বিশ্বাস এখনও, সেখানেই হয়। প্রয়োজনে তখন আলাদা করে উচ্চশিক্ষার প্রতিষ্ঠান হবে, যার সঙ্গে পরীক্ষা ও চাকরির কোনো সম্পর্ক থাকবে না। যারা আমৃত্যু জ্ঞানচর্চা করতে চান, তারা পড়াবেন। যারা চাকরির জন্য পড়াশুনা করেন, তারা উচ্চ মাধ্যমিক শেষ করে চাকরির পরীক্ষা দিয়ে কর্মজীবী হবেন। শিক্ষকের ক্ষমতা হোক ‘জ্ঞান’, ছাত্রদের ‘সুশিক্ষিত হওয়া’। সমাজ বদল এমনিতেই হবে।
মোজাফ্ফর হোসেন, অনুবাদক