‘যে ব্যক্তি আখেরি জামানায় ফিতনা-ফাসাদের যুগে একটি সুন্নত মোবারক আঁকড়ে ধরে থাকবে, তিনি একশ শহীদের মর্যাদা পাবেন।’ ওপরের হাদিসখানা বিখ্যাত হাদিসগ্রন্থ মিশকাত শরিফ থেকে উদ্ধৃত করা হলেও নবীজির পবিত্র এ বাণী ব্যবহার করা হচ্ছে ‘পণ্য বিক্রির প্রচারণায়’।
হাদিসের বাণী দিয়ে পণ্য বিক্রির এমন অভিনব পন্থা অবলম্বন করেছেন বর্তমানের অন্যতম সমালোচিত রাজারবাগ দরবারের পীর। যেখানে একজনের ব্যবহারের একটি সাধারণ আকারের কাঠের চৌকির দাম দেওয়া হয়েছে ২৮ হাজার টাকা। এর বাইরে আরও শতাধিক ‘সুন্নতি’ পণ্য বিক্রির প্রচারণা চলছে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায়। পণ্য, খাবারসহ সব কিছুতে ‘সুন্নতি’ ট্যাগ ব্যবহার কওে কোরআন ও হাদিসের বিভিন্ন বাণী যুক্ত করে চমকপ্রদ বিজ্ঞাপনে প্রচারণা চালানো হচ্ছে পণ্যের। যদিও শ্যাম্পু-সাবানসহ এমন বহু পণ্য সুন্নতের নামে বিক্রি করা হলেও এগুলো রাসুলের যুগে ছিল না বলে অভিমত ইসলাম বিশেষজ্ঞদের। এ ছাড়া ‘সুন্নাহডটইনফো’ নামে একটি ওয়েবসাইটের মাধ্যমেও চালানো হচ্ছে এমন প্রচারণা।
এদিকে রাজারবাগ দরবারের এ পীরের বিরুদ্ধে জোরপূর্বক ভক্তদের জমি দখল করতে মিথ্যা মামলা দিয়ে হয়রানিসহ নানা অভিযোগের তদন্ত চলছে। ইতোমধ্যে গতকাল মঙ্গলবার এ পীরের সব সম্পদের উৎস অনুসন্ধানসহ জঙ্গি সংগঠনের সম্পৃক্ততার খোঁজ ও পীরের সব আস্তানা বন্ধের নির্দেশ দিয়েছেন হাইকোর্ট।
রাজারবাগ পীরের পণ্য বিক্রির ওয়েবসাইট পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, সাধারণ আকারের একটি কাঠের চৌকির দাম ২৮ হাজার টাকা। চৌকির বিবরণীতে বলা হয়েছে- ‘চকি বা খাট তো সবাই ব্যবহার করেন। কিন্তু চৌকির মাপটা ও ডিজাইনটা যদি সুন্নত মোতাবেক হয়ে যায় তবে একই সঙ্গে আপনার অনেক সুন্নত পালন হয়ে যাবে। শুধু তাই নয়, পালিত হবে মহান আল্লাহ পাকের আদেশ মোবারকও।’ সুন্নতি চৌকির বর্ণনা দিতে গিয়ে বলা হয়েছে- ‘আমাদের প্রাণ প্রিয় নবীজির চকি মোবারক ছিল চার পায়াবিশিষ্ট এবং কাঠের তৈরি। এ ছাড়া চারপায়া চকির ছাউনি মোবারক ছিল দড়ির তৈরি, যার ফলে কখনও কখনও ওনার জিসিম (শরীর) মোবারকে দাগ পড়ে যেত।’
প্রত্যক্ষদর্শী ও রাজারবাগের পণ্য ব্যবহার করেছেন এমন বেশ কয়েকজন গ্রাহক বলেন, ইসলাম ও নবীজির সুন্নতের কথা বলে পণ্য বিক্রি করা হলেও পণ্যের মান খুবই সাধারণ। আবার সাবান-শ্যাম্পুসহ আরও বহু পণ্য রয়েছে যেগুলো রাসুলের যুগে না থাকলেও সুন্নতের নামেই সেগুলো বিক্রি করা হচ্ছে। তাদের প্রায় অর্ধশত গাড়ি রাজধানীর বিভিন্ন ব্যস্ততম সড়ক দখল করে দিনে ও রাতে পণ্য বিক্রি করে। রাজারবাগের তাদের দোকানে সরকারি বিভিন্ন রেশনের পণ্যও বিক্রি হয় বলে অভিযোগ। গত দুই বছর করোনা মহামারিকালে রাজধানীতে মাস্ক না পরে প্রচারণা চালাতে দেখা গেছে।
ওয়েবসাইটে সারা দেশে সর্বোপরি বিশ^ব্যাপী সুন্নত প্রচার করাই তাদের মূল লক্ষ্য বলে উল্লেখ করা হয়েছে। বাংলাদেশসহ বিশে^র বিভিন্ন দেশে যথাযথভাবে সুন্নত প্রচার না হওয়ায় দুঃখের সঙ্গে উদ্বিগ্নতা প্রকাশ করা হয়েছে। পণ্যের তালিকায়- খাবার, তৈজসপত্র, পোশাক, প্রসাধনী, ফল, মাসিক বাজার, ইসলামী বই, খাবার, মুদিপণ্য, গৃহসামগ্রী, প্রসাধনী, শিশুদের পণ্য, অফিস পণ্য এবং ইলেকট্রিক ও হার্ডওয়্যার পণ্য রয়েছে। ‘সম্মানিত সুন্নতেই মুক্তি’, ‘শতভাগ সুন্নত শতভাগ রহমত’, ‘বরকতময় সবকিছু সুন্নত মোবারকে নিহিত’, ‘সুন্নতি খাবার গ্রহণ করুন রোগ থেকে মুক্ত থাকুন’- এমন সব স্লোগান ব্যবহার করা হয়েছে। ওয়েবসাইটে দেওয়া তথ্যে দেখা গেছে, চৌকি ছাড়াও কালিজিরার ২০০ মিলির তেলের মূল্য ৪৮০ টাকা, জয়তুনের ৫০০ মিলি তেল ৭৫০ টাকা, এক লিটারের সিরকা ২০০ টাকা, কাঠের তরকারি বাটি ৫৯০ থেকে ৬৫০ টাকা এবং ছোটদের পোশাক ৫৫০ থেকে ৬০০ টাকা দেখানো হয়েছে।
এর আগে গত ৪ সেপ্টেম্বর ‘সুস্থ থাকতে পবিত্র সুন্নতি সামগ্রী ব্যবহারের বিকল্প নেই’ এমন স্লোগানে ঢাকার জাতীয় প্রেসক্লাবের আব্দুস সালাম হলে তাদের কথিত সুন্নতি খাবার, তৈজসপত্র, পোশাক-পরিচ্ছদসহ বিভিন্ন সামগ্রীর প্রদর্শনী ও আলোচনা সভার আয়োজন করে রাজারবাগ দরবার শরিফের আন্তর্জাতিক সুন্নত প্রচার কেন্দ্র। প্রেসক্লাবের সেই সেমিনারে নিজেদের পণ্যের গুণ বর্ণনা করেন রাজারবাগ পীরের মালিকানাধীন দৈনিক আল ইহসান ও মাসিক আল বাইয়্যিনাত পত্রিকার নির্বাহী সম্পাদক আবুল খায়ের মুহম্মদ আযীযুল্লাহ এবং মুহম্মদিয়া জামিয়া শরিফ মাদ্রাসার মুহতামিম মুহম্মদ আলমগীর হুসাইন।